কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৭ থেকে ২৫ জুলাই সারা দেশে কমপক্ষে ৫ হাজার জনকে গণগ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই গ্রেফতার হয়েছেন ২ হাজার ২০৯ জন। চলমান সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় সারা দেশে ১২৮টি মামলায় ৪৫১ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়, যার মধ্যে রাজধানীতে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও সহিংসতার ঘটনায় ২০১টি মামলা দায়ের করা হয়। ২৫ জুলাই পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও পরবর্তী সংঘাতে ২০৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
আন্দোলনের গতিপথ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া : চলমান অচলাবস্থার মধ্যে ২৫ জুলাই চার ঘণ্টার জন্য সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলা ছিল। কারফিউ শিথিল থাকায় রাজধানীতে দূরপাল্লার গণপরিবহনে যাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) কারফিউ শিথিল থাকা অবস্থায় লঞ্চ চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেও, জননিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২৬ জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে আন্তঃনগর ট্রেন চালানোর পূর্ব ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেয়।
আন্দোলনের নতুন মাত্রা ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ ইসলামের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নাহিদ ইসলামের নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পোস্ট করা হয়। এতে নাহিদ ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই। প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে সঙ্গেই এ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে না। বরং ছাত্র-নাগরিক হত্যা ও গুম-খুনের বিচার, রাষ্ট্রীয় ক্ষয়ক্ষতির বিচার, মামলা প্রত্যাহার ও ডাকসু সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনসহ নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি, আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ এবং সব ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী রাজনীতির উৎখাত ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিচারের দাবিতে দফাভিত্তিক আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার চিকিৎসাধীন আরো তিনজনের মৃত্যু হওয়ায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৩ জনে। এইদিন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনে জানায়, পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া : মিরপুর-১০ নম্বরে ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আহতদের চিকিৎসার সব ব্যয় এবং নিহতদের পরিবারের সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নেবেন।’ ২৫ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গ কর্তৃপক্ষ মৃতদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে স্বজনদের কাছে ৮৫টি লাশ হস্তান্তর করে। বাকি আটজনের লাশের পরিচয় না থাকায় ময়নাতদন্ত করে দাফনের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে দেওয়া হয়। চলমান পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কারফিউ শিথিলের সময়সীমা দুই ঘণ্টা বাড়িয়ে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা করা হয়। তবে শুক্র ও শনিবার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুরে কারফিউ অব্যাহত থাকবে বলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান। কারফিউর ষষ্ঠ দিনেও রাজধানীতে কঠোর সেনা টহল ছিল।
কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে এ দাবি করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক বাংলাদেশে দমন-পীড়নের নিন্দা জানিয়েছেন এবং সব আইন প্রয়োগকারী কার্যক্রম যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়ম ও মানদণ্ড মেনে চলে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে অচলাবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় চলমান এইচএসসির আগামী সপ্তাহের ২৮, ২৯, ৩১ জুলাই ও ১ আগস্টের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ‘জরুরি নন’, এমন কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার সব ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করা উচিত।’ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বাংলাদেশে সৃষ্ট পরিস্থিতির ওপর দেশটি তীক্ষè নজর রেখেছে এবং দ্রুত শান্তি ফিরে আসার আশা করে।
আন্দোলনকারীদের নতুন কর্মসূচির আলটিমেটাম : ২৫ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট চালু, কারফিউ তুলে দেওয়াসহ ‘জরুরি’ চার দফা দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম ২৫ জুলাই শেষ হয়। তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে না পারায় তারা নতুন কর্মসূচির ঘোষণা করতে পারেননি। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে আরেকটি অংশের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, যেখানে সমন্বয়ক হান্নান মাসুদের বরাত দিয়ে বলা হয়, ২৬ জুলাই বাদ জুমা সারা দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা ও শোক মিছিল করা হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সব অপরাধীকে অপসারণ’ শিরোনামে এক দফা দাবিতে শুক্রবার ‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়, যার মধ্যে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের সহযোগিতা করার বিষয়গুলো।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলি চালানো হয়নি। তারা জানায়, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন চলমান কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানান এবং গণহারে হয়রানি ও গ্রেফতার না করার অনুরোধ করেন।
কেকে/ এমএস