আলোচিত সাবেক বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গ্রেফতার হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে তাকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাকে যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডিবির (দক্ষিণ) যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম।
তার বিরুদ্ধে অন্তত দুটি মামলা রয়েছে। দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে গত ২৭ অগাস্ট তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন। এর আগে ২৫ অগাস্ট খায়রুলের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় মামলা করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ভূঁইয়া। মামলায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্যে দিয়ে দেশে গভীর রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। ব্যাহত হয় গণতন্ত্রে যাত্রা। আর এর মধ্যে দিয়েই দেশে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন চেপে বসে। ফলে এর দায় কোনোভাবেই খায়রুল হক এড়াতে পারেন না। তিনি বিচারপতি হিসেবে সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ না থেকে সরকারের অনুগত হিসেবে কাজ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করে তৎকালীন সরকারের ইচ্ছাকেই রায় হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
এ বি এম খায়রুল হক ২০১০ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ হয়ে যায়। খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার পর ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তাকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই মেয়াদ শেষে কয়েক দফা পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ১৩ অগাস্ট আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন খায়রুল হক।
খায়েরুল হকের গ্রেফতারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিলম্বে হলেও যে এতদিন পর তার (এবিএম খায়রুল হক) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার, সেজন্য আমি সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সঠিকভাবে তার তদন্ত হবে সব বিষয়গুলোর এবং সঠিকভাবে তার বিচার কাজ সম্পন্ন হবে, সেটাই আমরা আশা করি।’ গতকাল দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বিএনপি মহাসচিব এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
দেশের একজন বড় শত্রু গ্রেফতার হলো উল্লেখ রে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাতে চাই, বাংলাদেশের একজন বড় শত্রু, যিনি বাংলাদেশের একটা বিশাল ক্ষতি করেছেন একটা বিরাট পদে থেকে এবং সেই পদে থেকে তিনি বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করার ব্যাপারে দায়িত্বে ছিলেন, সেখানে তিনি সেই জায়গায় প্রতারণা আশ্রয় নিয়েছেন। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সাহেব।’ মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ‘তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত যে রায় দিয়েছিলেন সেটা এবং পরবর্তীকালে পূর্ণাঙ্গ যে রায় যাতে আকাশ ও পাতাল তফাৎ ছিল। যে সংক্ষিপ্ত রায়টা দিয়েছিলেন, সেটাও আমরা মনে করি এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক সংকট তৈরিতে নিঃসন্দেহে খায়রুল হক দায়ী ছিলেন।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘খায়রুল হকের রায়ের পরে যেটা হয়েছে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক বিধানটা বাতিল হলো। যেটার কারণে বাংলাদেশে পরবর্তীকালে যত রকমের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা মনে করি বিচার বিভাগ সবচেয়ে বড় জায়গা, যেখানে মানুষের আস্থা থাকে, সেই আস্থার জায়গাটা উন ধ্বংস করেছেন শুধু তার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সেই কারণে, যেটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে বলে আমরা মনে করি।’
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগে মামলা
গত বছরের ২৫ আগস্ট এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে মামলা হয়। মামলায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ভূঁইয়া মামলাটি করেন বলে জানান ফতুল্লা মডেল থানার ওসি নূরে আযম।
এজাহারে বলা হয়, আসামি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় সংবিধানের ত্রয়োদশ মামলার শুনানিকালে সুপ্রিম কোর্টের আটজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মতামত দেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক, বিচারপতি এস কে সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দেন। অন্যদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিঞা, নাজমুন আরা সুলতানা ও ঈমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন।
বাদী অভিযোগ করেন, বিষয়টি সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আগেই বুঝতে পেরে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে কাস্টিং ভোট দেন। ফলে রায়টি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের চার-তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। মামলায় বলা হয়, ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে সরকার তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।
যদিও প্রকাশ্য আদালতে বিচারপতি খায়রুল হক পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে উল্লেখ করেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় সর্বসম্মত ছিল না দাবি করে মামলার এজাহারে বলা হয়, রায় দেওয়ার পরপরই খায়রুল হক অবসরে চলে যান। প্রকাশ্য আদালতে দেওয়া রায়টি পরিবর্তন করে আসামি এ বি এম খায়রুল হক বিশ্বাস ভঙ্গ, প্রতারণা করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন বলে মামলায় উল্লেখ করেন বাদী।
প্লট দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক
এবিএম খায়রুল হক বিধিবহির্ভূতভাবে পূর্বাচলে একটি প্লট নিয়েছেন এমন অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গতকাল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান এবং উপকর কমিশনারের কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করেছে দুদক। অনুসন্ধানের বিষয়টি জানিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বিধিবহির্ভূতভাবে একটি প্লট নিয়েছেন এরকম একটি অভিযোগ অনুসন্ধানে নথিপত্র চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’
এ অভিযোগের অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মনিরুল ইসলামকে দলনেতা করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। দলের অন্য সদস্যরা হলেন : সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, মুবাশ্বিরা আতিয়া তমা, এস এম রাশেদুল হাসান, এ কে এম মুর্তুজা আলী সাগর, মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম এবং উপ-সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।
খায়রুল হকের যত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
বিচারাঙ্গনে তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এই বিচারপতির কয়েকটি রায় চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তিনি নিজে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা করে সমালোচিত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার কয়েকদিন আগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। এতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি শেখ হাসিনার ভোট ডাকাতির চূড়ান্ত সুযোগ তৈরি হয়।
রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া বিতর্কিত একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। আইন কমিশনে গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করতেন এসএম সামসুল আলম। ২০১৩ সালে ক্ষমতার ব্যবহার করে সামসুল আলমকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান এ বি এম খায়রুল হক। সামসুল আলম চাকরি হারিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি তিনি চাকরি ফেরত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর আবেদন করেছেন।
কেকে/ এমএস