মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) হারিয়েছে তিনজন শিক্ষার্থীকে। ঘটনাগুলো ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কিন্তু প্রতিটির পরিণতি একই—মর্মান্তিক মৃত্যু। আত্মহত্যা, রহস্যজনক মৃত্যু এবং সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে গেছে তিনটি প্রাণ। ক্যাম্পাসজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে।
সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা ঘটে গত ১৮ জুলাই। রাজধানী বাড্ডার ছাপড়া মসজিদের পাশের একটি ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নিশীতা আক্তারের ঝুলন্ত মরদেহ। গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। মৃত্যুর আগে একটি সুইসাইড নোটে তিনি লেখেন—‘বাবা আমাকে মাফ করো। আমার কাছে একজন কিছু টাকা পায়—তাকে টাকা দিয়ে দিও।’
এ ঘটনায় নিহতের সহপাঠী ফারজানা আক্তার বলেন, পুলিশ সুইসাইড নোট পেয়েছে যেখানে পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে ৬ হাজার টাকা পাওনার কথা লিখে গেছে সে। ধারণা করা হচ্ছে সম্পর্কজনিত হতাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত।
এর এক মাস আগের ঘটনা—১৪ জুন, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নূরজাহানপুর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ডিআইইউ’র অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার। দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিভে যায় শিক্ষার্থী তামান্নার জীবন। এটি ছিল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা।
এর আগে, গত ১৯ মে নিখোঁজ থাকার চার দিন পর উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকায় মেট্রোরেল লাইনের ১২৫ নাম্বার পিলারের পাশ থেকে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসানের রক্তাক্ত মরদেহ। তার শরীরে ছিল স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন। এটি দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা না পরিকল্পিত হত্যা—তা এখনো নিশ্চিত নয়।
এ ঘটনায় মাহমুদুল হাসানের রুমমেট সাদিক জানিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমি রুমে আসি। আসার পর দেখি মাহমুদুল ভাই নিজেই নিজের সাথেই একা একা কথা বলছে। আমার কাছে বিষয়টা অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক এবং কোন সমস্যা আছে মনে হলো। আমি এসব প্রশ্ন করতেই তিনি অস্বীকার করলেন। পরে ঘুমানোর আগে তিনি ফোনে কার সাথে যেন কথা বললেন। ঘুম থেকে ওঠার পর আমাকে বলতেছে আমার ফোন নাকি হারিয়ে গেছে এটা খুঁজতে বাহিরে যাচ্ছি। এই বলে সে চলে গেল।
তামান্নার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা হলেও নিশীতা ও মাহমুদুলের মৃত্যু স্পষ্টভাবে মানসিক চাপ ও হতাশার প্রতিফলন। আত্মহত্যার আগে নিশীতার নোট, নিঃসঙ্গতা এবং দায়িত্ববোধের ভার; আর মাহমুদুলের অস্বাভাবিক আচরণ, নিঃসঙ্গতা ও মানসিক অস্থিরতা—সবই গভীর হতাশার ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন হামিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সেবা থাকলেও আমরা জানি না সেটি কোথায় বা কীভাবে পাওয়া যায়। এর প্রচার দরকার এবং সেটি যেন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ না থাকে।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, মাহমুদুল ভাই হয়তো ভয় বা মানসিক দ্বন্দ্বে ছিলেন। সময়মতো এগুলো বোঝা গেলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেত।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জাহিদুল ইসলাম বলেন, এভাবে শিক্ষার্থীদের হারানো আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমাদের মেডিকেল সেন্টার ও চিকিৎসক রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা যদি তাদের সমস্যাগুলো কাউন্সিলর বা শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করে তাহলে আমরা দ্রুত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা মোহাম্মদ শাহ আলম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিষয়ে সচেতন করতে সেমিনার ও ইয়োগা কর্মসূচির পরিকল্পনা চলছে। তবে শিক্ষার্থীদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন কারণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে তারা নিজেরাও সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে চান না।
কেকে/এএম