তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ১৫ বছর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। তবে বর্তমান সময়ে প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে পুনর্জাগরণের পথে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে উন্নতমানের জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রশাসন, অ্যালামনাই এসোসিয়েশন এবং সামাজিক সহায়তার প্ল্যাটফর্মগুলোর যৌথ উদ্যোগ প্রয়ােজন।’
রোববার (১২ অক্টোবর) রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতাকালে তিনি এসব কথা বলেন।
শিক্ষাবান্ধব মানসিকতার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘অবকাঠামোগত ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে নব উদ্যমে এগিয়ে নেওয়ার যাত্রায় সংযুক্ত থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সঠিক দিক নির্দেশনা পেলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরবঙ্গ তথা দেশের মধ্যে উন্নত জ্ঞানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে আগামীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।’
প্রতিষ্ঠাকালীন ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ’ এর আহ্বায়ক শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. রেজাউল হক তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেবল উত্তরবঙ্গের নয়, বরং গোটা দেশের উচ্চশিক্ষা বিকাশের এক উজ্জ্বল প্রতীক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল একটি দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস, যা উত্তরবঙ্গের মানুষের শিক্ষা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। আজ থেকে ১৭ বছর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছিল।’
প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. এম লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি তার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষণার মানের মধ্যে নিহিত। তাই এখন সময় এসেছে গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা অপরিহার্য।’
প্রফেসর লুৎফর রহমান আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন মানে কেবল ভবন নির্মাণ নয়, বরং চিন্তা চেতনার বিকাশ সাধন। আমরা যদি মুক্তবুদ্ধি, মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার পরিবেশ তৈরি করতে পারি তাহলেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে জ্ঞান-আলোকের কেন্দ্র হয়ে উঠবে।’
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. রাশেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে একটি স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে শিক্ষা ও গবেষণায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছে।’ ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরিতে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর নানা চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে আমরা এখন এক নবজাগরণের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। বর্তমান প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়কে একাডেমিক উৎকর্ষের পথে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। আমরা ইতিমধ্যে গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ, নতুন ইনস্টিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শেখার সুযোগ তৈরি করতে শিল্প-একাডেমিক সংযোগ জোরদার করা হচ্ছে।’
উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো বেরোবিকে আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষক যদি নিজের জায়গা থেকে সততা, মেধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে খুব শিগগিরই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সারিতে স্থান করে নেবে।’
ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. ইলিয়াছ প্রামানিকের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন মো. ফেরদৌস রহমান, ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মো. তাজুল ইসলাম, রেজিস্ট্রার ড. মো. হারুন-অর রশিদ, সুজন রংপুর মহানগরের সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শামসুর রহমান সুমন, একাউন্টিং এন্ড ইনফরশেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী আহমাদুল হক আলভীর, সাবেক শিক্ষার্থী অনিন্দ কুমার রায় ও আবু সাঈদ আল সাগর, প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মকর্তা অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. ময়নুল আজাদ, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এমএলএসএস মো. আব্দুল মান্নান মন্ডল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
আলোচনায় সভায় অতিথিবৃন্দকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। এ সময় ‘কিক মেক দ্য ডিফারেন্স স্কলারশীপ ২০২৫’ এর আওতায় বেরোবির ৫ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। কিক রিটেইলার ব্র্যান্ড এর অর্থায়নে ও জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসেস এর সহায়তায় এ বৃত্তি বেরোবিতে চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে “শিক্ষা, গবেষণা ও বিপ্লবের চেতনায় দীপ্ত হোক- বেরোবির আগামী” শীর্ষক স্লোগানকে ধারণ করে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিবসটির আনুষ্ঠানিকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন করেন রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. রেজাউল হক ও উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী। পরে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবর্ষিকী উপলক্ষে ক্যাম্পাসে বর্ণিল আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়। বাদ্যের তালে তালে শোভাযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে শহীদ আবু সাঈদ চত্বর হয়ে ক্যাডেট কলেজের মোড় প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসে ফিরে এসে শেষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বর্ণিল এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন।
শোভাযাত্রা শেষে স্বাধীনতা স্মারক মাঠে এক আনন্দঘন পরিবেশে সম্মানিত অতিথিবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে উপাচার্য প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক কাটেন। দিবসটি উপলক্ষে বিকেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
বাদ আসর কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এছাড়া সন্ধ্যায় স্বাধীনতা স্মারক মাঠে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোকসজ্জ্বাসহ নানাভাবে সাজানো হয় ক্যাম্পাস।
কেকে/কেটি