গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে গত বুধবার দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার পর জারি করা কারফিউর সময় বেড়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত জেলায় কারফিউ থাকবে। বৃহস্পতিবার ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে নতুন করে শুরু হওয়া কারফিউ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। তবে শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করে কারফিউর বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এর আগে গত বুধবার রাত আটটা থেকে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ দেওয়া হয় গোপালগঞ্জ জেলাজুড়ে। কারফিউ জারির আগে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় গোপালগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল প্রশাসন। এতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে জেলাটিতে। প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন মানুষ; তবে সে সংখ্যা খুবই সীমিত। সকালে সেখানে থমথমে পরিবেশ দেখা যায়। সংখ্যায় কম হলেও জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া এসব মানুষ বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটছেন। রাস্তায় গাড়ি চলছে কয়েকটা। শহরের মোড়ে মোড়ে সেনাবাহিনী ও বিজিবি টহল দিচ্ছে। কারফিউর কারণে গোপালগঞ্জে গতকালকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
এর আগে হামলাকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে ৪ জন নিহত এবং অন্তত ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এরপর বিকালে জেলা প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গোপালগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে।
এদিকে এ ঘটনার পর শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। তবে বিভিন্ন মোড়ে চায়ের দোকান ও রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে। সেখানে মানুষের জটলা দেখা যায়। কাঁচা বাজার এলাকায় রাস্তার পাশে বেশ কিছু ফলের দোকানে লোকজন ছিলেন। এদিকে কারফিউয়ের কারণে স্থানীয়ভাবে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে ঢাকাসহ দূরপাল্লার যানবাহন চলছে স্বাভাবিকভাবেই।
সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহতদের দাফন-সৎকার : গোপালগঞ্জে দফায় দফায় এনসিপি নেতাদের সঙ্গে হামলা-সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত চারজনের কারোর সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত হয়নি; রাতেই তাদের দাফন ও সৎকার সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার দিনভর সংঘর্ষে নিহতরা হলেন শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৭), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন।
এর মধ্যে পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহাকে বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার করা হয়। এ ছাড়া টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজীকে বুধবার রাতে এশার নামাজের পর এবং মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সোহেল রানা ও ক্রোকারিজ দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদারকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত নিয়ে মৃতের পরিবারের সদস্যরাও কেউ কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না।
গতকাল বিকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গোপালগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করা হয়। সেখানে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিকের কাছে সাংবাদিকরা সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের বিষয়ে জানতে চান। তখন তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আইন প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে দেখা হবে।’ এ সময় তিনি আরো বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় পুলিশের কারো গাফিলতি আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।
রমজানের চাচা মনিরুজ্জামান বুধবার রাতে একটি গণমধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ঘটনার সময় রমজান শহর দিয়ে হেঁটে কাজে যাচ্ছিল। এ সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়। সে ছিল টাইলস মিস্ত্রি।’ পরিবার কোটালীপাড়ার হলেও রমজানের জন্ম-কর্ম শহরেই বলে জানান তার চাচা। তিনি বলেন, রাতে মরদেহ হাসপাতাল থেকে স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে শহরের কবরস্থান মসজিদে রমজানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই রাতে তাকে দাফন করা হয়েছে।
দীপ্ত সাহার বাবা সন্তোষ সাহা মারা গেছেন। দুই ভাই শহরের চৌরঙ্গী এলাকায় একটি তৈরি পোশাকের দোকান চালান। সংঘর্ষের মধ্যে দোকান থেকে বাসায় যাওয়ার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
গোপালগঞ্জে বড় হামলার গোয়েন্দা তথ্য ছিল না : গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের হামলার গোয়েন্দা তথ্য ছিল না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
এখন গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গোপালগঞ্জে যারা অন্যায় করেছে তাদের গ্রেফতার করা হবে, কাউকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্য ছিল, এতকিছু হবে ওই তথ্য ছিল না।’
গোপালগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ এনসিপির এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলতে পারেন, যার যার ক্ষোভ সে দেবে।’
সহিংসতায় ৪ জন নিহত, অর্ধশতাধিক আহত : গোপালগঞ্জে সহিংসতায় চারজন নিহত এবং ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ প্রায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। পুলিশের তৈরি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গণমাধ্যমে এ প্রতিবেদন সরবরাহ করে।
পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত ৪ জনের মরদেহ পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। এখনো পর্যন্ত যৌথবাহিনী ও পুলিশ নাশকতার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গোপালগঞ্জ জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে এক হাজার ৫০৭ জন পুলিশ সদস্যসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে বর্তমানে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রয়েছে।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় তদন্ত কমিটি : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান। কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি। তার সঙ্গে দুজন অতিরিক্ত সচিব থাকবেন, একজন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এবং অপর সদস্য আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের। এ কমিটিকে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত পরিচালনা করতে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখা, জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং যে কোনো বেআইনি কাজ, সহিংসতা এবং মৃত্যুর জন্য দায়ীদের আইন অনুসারে জবাবদিহি করা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেও জানানো হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, তদন্ত কমিটি পুরো ঘটনা তদন্ত করবে। ঘটনা কেন হলো, কীভাবে মৃত্যুগুলো হলো সব বিষয় দেখবে তদন্ত কমিটি। সহিংসতা কারা করল সেটিও দেখা হবে।
সরকারের উদাসীনতায় গোপালগঞ্জে হামলা : জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের প্রধান সমন্বয়কারী নিজাম উদ্দিন বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উদাসীনতার কারণেই গোপালগঞ্জে হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে বোঝা যায় সেখানে এমন কিছু ঘটতে পারে, যা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগেই জানত। তবে এতটা ভয়াবহ হবে তিনি নাকি জানতেন না। গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ মঞ্চ ভাঙচুর ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা উপলক্ষে গতকাল দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
নিজাম বলেন, মূলত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধা নাহিদ, আখতার, হাসনাত ও সার্জিসকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে এ বর্বর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে দিনভর হামলা-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় বুধবার রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা। সংঘর্ষে নিহত হন চারজন। আরো অনেকে গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থায় তিনজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
কেকে/ এমএস