গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দেশজুড়ে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে দলটির নেতাকর্মীরা। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বারবার কঠোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে বহিষ্কারাদেশসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেওয়া হয়। তবুও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না দলের বেপরোয়া নেতাকর্মীদের। সর্বশেষ যুবদল কর্মীদের নৃশংসতার শিকার হয়েছেন পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী।
গত বুধবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) নামের এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। জানা গেছে, অভিযুক্তরা সবাই যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
জানা গেছে, গত বুধবার পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল কম্পাউন্ডে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ব্যবসায়ী সোহাগ। সেখানে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এরপর নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে কম্পাউন্ডের বাইরের সড়কে এনে শত শত মানুষের সামনে চলে উন্মত্ততা। ঘটনাস্থলের একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতায় আমি স্তব্ধ! কঠোর হোন বিএনপি নেতৃত্ব, সরকার, প্রশাসন। অবিলম্বে থামান এ বীভৎস তাণ্ডব।’
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘চকবাজারের খুনের ঘটনায় দায়ী প্রত্যেককে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও অপরাধ করে কারো পার পাওয়ার সুযোগ নাই। খুনি সন্ত্রাসীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য তদন্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি করা যাবে না। খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। ভিকটিম পরিবারকে আইনি সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অপরাধ দমনে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিএনপি ও বিএনপির কোনো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট যারা আছেন আপনারা কেউ কোনো ধরনের অপরাধীকে প্রশ্রয় দেবেন না। দলীয় পরিচয়ের আড়ালে যদি কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে চায় আমরা তাদের প্রতিহত করব।’
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার দলের নরপিশাচদের সামলান। গতকাল নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে সারজিস আলম এসব কথা বলেন। স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘আপনার দলের নেতাকর্মী নামধারী কতিপয় নরপিশাচকে সামলান, জনাব তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের খুনের দায় যেমন শেখ হাসিনার ওপর বর্তায়, তেমনি বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের করা খুনের দায়ও আপনার ঘাড়ে বর্তায়। এ বর্বরতাকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়ার’ সময়ের বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করে সারজিস লেখেন, ‘মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে একজন ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে হত্যা এবং তার লাশ ঘিরে বুনো উল্লাস এ দৃশ্য কল্পনা করাও কষ্টকর। এমন ঘটনা বাংলাদেশের মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।’
গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সোহাগ হত্যার ঘটনায় তার বড় বোন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার ভিত্তিতে পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় এবং এজাহারভুক্ত আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১) ও তারেক রহমান রবিনকে (২২) গ্রেফতার করে। তারেক রহমান রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল জব্দ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে হত্যা মামলায় মাহমুদুল হাসান মহিনকে ৫ দিন এবং তারেক রহমান রবিনকে অস্ত্র মামলায় ২ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মহিন ও তারেক নামের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার সময় অদূরেই চলছিল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা, নিরাপত্তায় ছিলেন আনসার ক্যাম্পের সদস্যরাও। তবে এমন সন্ত্রাস আতঙ্কে কেউ এগিয়ে আসেনি। যখন তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়, তখন চিকিৎসক জানান, আগেই মারা গেছেন সোহাগ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা। সোহাগের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও লাশের ওপর চলতে থাকে নৃশংসতা। রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে ফেলে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে চলে ভয়াবহ উন্মত্ত উল্লাস। একজন নয়, একাধিক যুবক মৃত ব্যক্তির নাক-মুখে এবং বুকের ওপর আঘাত করে যেতে থাকে।
এদিকে ভিডিওতে দেখা যায়, নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা লোকদের মধ্যে একজন মোবাইলে কথা বলছিল। ওই সময় দুই হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা সোহাগের রক্তাক্ত মুখের ওপর কিলঘুষি দিতে থাকে আরেকজন। অন্য এক তরুণ দৌড়ে এসে পড়ে থাকা নিথর দেহের বুকের ওপর লাফাচ্ছিল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, নিহত সোহাগ মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসার সঙ্গে পুরোনো বৈদ্যুতিক ক্যাবল কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। তার দোকানের নাম সোহানা মেটাল। ওই এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণ ছিল সোহাগের কাছে। তবে নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মাহমুদুল হাসান মহিন ও সারোয়ার হোসেন টিটু নামে আরো দুজন। তারা অনেকটা ওই অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। তা না হলে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল তারা। এর জেরেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্বে ঘটে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ঘটনার দিন সোহাগকে তার দোকান থেকে ডেকে আনা হয়েছিল।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিহত সোহাগ ও হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া মহিন, টিটুসহ জড়িত অন্যরাও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে সংগঠনে তাদের কোনো পদ রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী ও আনিসুর রহমান হাওলাদারসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়।
দুই নেতাকে আজীবন বহিষ্কার করলো যুবদল
এ নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় দুই নেতা রজ্জব আলী পিন্টু ও সাবাহ করিম লাকিকে আজীবন বহিষ্কারাদেশ করেছে যুবদল। এর পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে তারা। শুক্রবার রাতে যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
কেকে/ এমএস