চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে নৌবাহিনী পরিচালিত সংস্থা চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। সোমবার থেকে ছয় মাসের জন্য এনসিটির দায়িত্ব গ্রহণ করে ড্রাইডক কাজ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে রোববার রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে নতুন করে আর কোনো চুক্তি করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, ড্রাইডকের সঙ্গে পরিচালনা-চুক্তি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়েছে। তারা রোববার রাত ১২টা থেকে কাজ শুরু করেছে। সাইফ পাওয়ারটেকের সব কর্মকর্তারা ড্রাইডক লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
বন্দর সচিব বলেন, প্রথমে পরিকল্পনা ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজে টার্মিনাল চালাবে। কিন্তু পরে সরকারের পক্ষ থেকে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। তবে আইনি জটিলতার কারণে সরাসরি নৌবাহিনীকে না দিয়ে তাদের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ড্রাইডকের হাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বন্দরের এ রদবদলের পেছনে দীর্ঘদিনের অস্বচ্ছ চুক্তি, বিগত ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠতা এবং নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ পরিবর্তনের দাবি করে আসছিলাম। সাইফ পাওয়ারটেক গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল।
২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বন্দরের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম একচেটিয়াভাবে পরিচালনার সুযোগ নেয়। দেড় দশক পর বিতর্কিত এ প্রতিষ্ঠানটির জায়গায় টার্মিনাল এখন ড্রাইডক পরিচালনা শুরু করেছে।
প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে বছরের পর বছর টেন্ডার ছাড়াই চুক্তি নবায়ন করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কখনো টেন্ডার হলেও শর্ত এমনভাবে নির্ধারণ করা হতো যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে।
বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, নূর-ই-আলম চৌধুরী, সামশুল হক চৌধুরী ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে। সেই ‘ঘনিষ্ঠতাই’ ছিল তার মূল পুঁজি। এর মাধ্যমে তিনি শুধু বন্দর নয়, আরো অনেক বড় সরকারি প্রকল্পেও প্রবেশাধিকার পান।
সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগও কম নয়। ২০২২ সালে দুবাইভিত্তিক সাফিন ফিডার কোম্পানির সঙ্গে কথিত সমঝোতার ঘোষণা দিয়ে শেয়ারবাজারে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা তুলেছে এমন অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে খোলা প্রতিষ্ঠান ‘সাইফ মেরিটাইম এলএলসি’-তে কীভাবে অর্থ স্থানান্তর হলো, তা নিয়েও চলছে অনুসন্ধান।
এখন সরকারের একাধিক সংস্থা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থপাচার, রাজস্ব ফাঁকি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এনসিটি বিদেশিদের হাতে না দেওয়ার দাবিতে কিছু পক্ষ সোচ্চার হলেও, অনেকেই মনে করেন এই ‘আন্দোলনের’ আড়ালে প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সাইফ পাওয়ারটেককে টিকিয়ে রাখা। এমন প্রেক্ষাপটে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন একটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট ফাঁস করেন, যেখানে সাইফ পাওয়ারটেকের এমডি রুহুল আমিন বন্দর অচল করার জন্য ‘টাকা ঢালার’ নির্দেশ দেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ড্রাইডকের এই দায়িত্ব গ্রহণ প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও কার্যকর পরিচালনায় কতটা সফল হবে তা নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ নজরদারির ওপর।
কেকে/ এমএস