দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর চোখে কর্মসংস্থান, রাজনীতি এবং সংস্কার তিন ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা। শিক্ষাব্যবস্থাকে অপ্রাসঙ্গিক, চাকরির বাজারকে অনিয়মতান্ত্রিক এবং রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন মনে করছেন অধিকাংশ তরুণ। চাকরির বাজারে দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা, দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষতার ঘাটতি ও নীতিগত সমন্বয়ের অভাবে হতাশ তরুণ প্রজন্মের অর্ধেকই বেকারত্বের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। চাকরি পাওয়ার আশায় কেউ কেউ বছরের পর বছর ধরে নীরব প্রতীক্ষায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মসংস্থান নীতিতে যুগোপযোগী সংস্কার, দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ এবং স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া ছাড়া এই হতাশা আরো বাড়বে।
দক্ষিণ এশীয় গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে এমন তথ্য। গতকাল সোমবার রাজধানীর ব্র্যাকইন সেন্টারে অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে সানেম। এই গবেষণায় সহযোগিতা করেছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, মাত্র ১৪.৫৪ শতাংশ তরুণ বিশ্বাস করেন যে, তাদের শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতা তাদের কর্মজীবনের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত করেছে। বিপরীতে ৩০.৭৮ শতাংশ মনে করেন তাদের শিক্ষার কোনো ভূমিকা ছিল না কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। কর্মজীবনের আকাক্সক্ষার দিক থেকে ৩৬.৯৯ শতাংশ সরকারি চাকরির প্রতি তাদের ঝোঁক প্রকাশ করেছেন, এরপরে ২৬.৪১ শতাংশ উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহী। তরুণদের মধ্যে ৪১.৭৫ শতাংশ নারী সরকারি খাতের চাকরি পছন্দ করেন, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৩২.৮৭ শতাংশ।
চাকরির সন্ধানে তরুণদের অভিজ্ঞতা বেশ হতাশাব্যঞ্জক। ২৮.৬৬ শতাংশ তরুণ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো কাজের সন্ধানে রয়েছেন। আর যারা গত এক বছরে অন্তত একটি চাকরির জন্য আবেদন করেছেন, তাদের মধ্যে ৪৫.১২ শতাংশ কখনোই কোনো সাক্ষাৎকারের ডাক পাননি যা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এবং প্রতিযোগিতার তীব্রতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের দিকটিও অনগ্রসর। জরিপে দেখা যায়, গত এক বছরে মাত্র ১১.৬৮ শতাংশ তরুণ কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে ৪৮.৭ শতাংশ পেয়েছেন কম্পিউটার ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ যা বর্তমান সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক হলেও সার্বিকভাবে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তা যথেষ্ট নয়।
জরিপের তথ্যে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে ১.৭ শতাংশ তরুণ বিদেশে কাজ করে দেশে ফিরে এসেছেন এবং তাদের মধ্যে ৭২.৭৩ শতাংশ আবার যেতে আগ্রহী। যারা কখনো বিদেশে যায়নি, তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বিদেশ যেতে চান এবং ৫৭.৩ শতাংশ দেশে থেকেই কিছু করতে চান। যারা দেশে থাকতে চান, তাদের মধ্যে নারীর হার ৭০.৫৭ শতাংশ, আর পুরুষের ৪৫.৫৭ শতাংশ। বিদেশে যাওয়ার প্রধান মোটিভেশন উচ্চ বেতন, ভালো সুযোগ-সুবিধা, আর উন্নত জীবনযাত্রার প্রত্যাশা।
ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে ৪২.৩৪ শতাংশ তরুণ একেবারেই অবগত না, আর মাত্র ৯.৯৯ শতাংশ একে ভালোভাবে চেনে। তবে ৭০.৮ শতাংশ তরুণ মনে করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো স্বাধীনতা ও বাসা থেকে কাজ করার সুযোগ, আর ৫৮.৭ শতাংশ মনে করে এটি দেশীয় চাকরির তুলনায় বেশি আয় দেয়।
চাকরির বাজারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ৫৪.৭২ শতাংশ তরুণ ঘুষ ও স্বজনপ্রীতিকে চিহ্নিত করেছে। এরপর পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব ৫২.৬৭ শতাংশ, চাকরির সুযোগের স্বল্পতা ৫০.০২ শতাংশ এবং শিক্ষার সাথে চাকরির বাজারের অসামঞ্জস্য ৪৯.৩৮ শতাংশ। জরিপের সঙ্গে থাকা কেস স্টাডিগুলো এ বাস্তবতাকে আরো স্পষ্ট করে তোলে একজন মাস্টার্সধারী স্কুল শিক্ষিকা ও সিঙ্গেল মাদার মাসে মাত্র ৫০০০ টাকার কম আয় করেন।
জুলাই আন্দোলন-পরবর্তী রাজনীতি ও সংস্কার নিয়ে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গিও জরিপে তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক সচেতনতার দিক থেকে দেখা যায়, মাত্র ২৩.৩৭ শতাংশ তরুণ নিয়মিত রাজনীতি অনুসরণ করে, ৩৯.০৯ শতাংশ মাঝে মাঝে করে, আর ৩৭.৫৪ শতাংশ একেবারেই আগ্রহী না। নারীদের মধ্যে ২৪.২৭ শতাংশ জাতীয় রাজনীতিতে আগ্রহী না, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এ হার ১৬.৪৮ শতাংশ। ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতি অনুসরণকারী তরুণের হারও খুব কম পুরুষদের মধ্যে ৯.৩১ শতাংশ ও নারীদের মধ্যে মাত্র ৫.১৮ শতাংশ। আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পুরুষদের মধ্যে ১২.৩৮ শতাংশ ও নারীদের মধ্যে ১৯.৮৫ শতাংশ একেবারে অনবগত, যেখানে মাত্র ৯.১২ শতাংশ পুরুষ ও ৪.৬৪ শতাংশ নারী এই বিষয়ে ভালোভাবে অবগত।
তথ্য পাওয়ার উৎস হিসেবে তরুণদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় ৮৭.৪ শতাংশ, এরপর আছে টেলিভিশন ৪৭.৭ শতাংশ, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা ৩৬.৮ শতাংশ এবং পত্রিকা ১৩ শতাংশ। রেডিও এবং অন্যান্য মাধ্যমগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক কম ব্যবহৃত হয়।
রাজনৈতিক দলের কার্যকারিতা নিয়ে তরুণদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি স্পষ্ট। মাত্র ১১.৮২ শতাংশ মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা দেশের প্রকৃত সমস্যা প্রতিফলিত করে, যেখানে ৪৯.৪২ শতাংশ একেবারেই এ বিষয়ে একমত নন। অর্ধেক তরুণ অর্থাৎ ৫০.১ শতাংশ মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সঙ্গে কোনো সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি, আর বিপরীতে মাত্র ১৬.১ শতাংশ তরুণ মনে করেন যে দলগুলো তরুণদের সঙ্গে যুক্ত।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়েও তরুণদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। মাত্র ৩.৩ শতাংশ মনে করেন সংস্কার ছাড়াই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তবে ৫৬.৪ শতাংশ বিশ্বাস করেন, যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। অপরদিকে, ১১.৩ শতাংশ তরুণ ভবিষ্যতে পরিস্থিতির আরো অবনতি দেখছেন এবং ১৩.১ শতাংশ মনে করেন, কিছুই পরিবর্তন হবে না।
এই পরিস্থিতির প্রতিফলন দেখা যায় রাজনীতিতে ভবিষ্যতে অংশগ্রহণ নিয়ে তরুণদের মনোভাবেও। ৮২.৭ শতাংশ তরুণ কোনোভাবেই রাজনীতিতে যুক্ত হতে আগ্রহী নন। ১১.৫ শতাংশ তরুণের মধ্যে কিছুটা আগ্রহ আছে এবং মাত্র ১.৬ শতাংশ বর্তমানে কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিয়ে তরুণদের প্রত্যাশা অনেকটাই আদর্শভিত্তিক। ৬০ শতাংশ তরুণ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন যে তারা পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক সহিংসতা দূর করবে। ৫৪ শতাংশ চায় নিয়মিত নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক। পাশাপাশি, ৪৮.২৩ শতাংশ তরুণ মনে করেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত নয়। যারা এর বিপক্ষে, তাদের মধ্যে ৮৭.৭৭ শতাংশ অ-মুসলিম, আর যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সমর্থন করেন, তাদের মধ্যে মাত্র ১২.২৩ শতাংশ অ-মুসলিম।
সকল ধর্মীয় পটভূমির তরুণদের মধ্যেই ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ৩৮.৩ শতাংশ তরুণ এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন, এবং ৮.৯ শতাংশ খুবই চিন্তিত। ২২.৮ শতাংশ মনে করেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তবে ১১.৬ শতাংশ বিশ্বাস করেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই তা হতে পারে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা গেছে। প্রায় ২১.১৭ শতাংশ তরুণ পর্যবেক্ষণ করেছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমেই বেশি অনিরাপদ অনুভব করছে। এই গোষ্ঠীর মধ্যে ৫৩.২৪ শতাংশ অ-মুসলিম, যারা নিজেরাও ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেন।
জরিপের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরম্যান্স মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তরুণদের মতামত মিশ্র ছিল। ৫৩ শতাংশ মনে করেন, সরকার সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সফল হয়েছে, যেখানে ১৫.৬ শতাংশ এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে ৩৯.১ শতাংশ ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে ১৯.২ শতাংশ কোনো অগ্রগতি দেখেননি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও মতভেদ দেখা যায় ৩৩.৬ শতাংশ উন্নতি দেখেছেন, কিন্তু ২৮.২ শতাংশ মনে করেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বজায় রাখা হয়নি। মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে ৫৬ শতাংশ মনে করেন, এখন মানুষ বেশি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে, তবে ১৯.৩ শতাংশ একমত নন। এই তথ্যগুলো তরুণদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে যেখানে তারা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রতি একদিকে হতাশ, অন্যদিকে পরিবর্তনের জন্য সত্যিকারের সংস্কারপ্রত্যাশী।
তবে, দেশের তরুণদের মধ্যে ৯৩.৯৬ শতাংশই আশাবাদী যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তবে ৬.০৪ শতাংশ ইতোমধ্যেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ৭৬.৭৮ শতাংশ তরুণ, অন্যদিকে ৪.১৪ শতাংশ তরুণ ভোট দিতে অনাগ্রহী।
জরিপে তথ্যানুযায়ী আগামী নির্বাচনে তরুণদের মতে বিএনপি সবচেয়ে বেশি ৩৮.৭৬ শতাংশ ভোট পাবে, এরপর জামায়াতে ইসলামী ২১.৪৫ শতাংশ, অন্যান্য ইসলামপন্থী দল, এনসিপি ও জাতীয় পার্টির অবস্থান আরও নিচে। এ ছাড়া, যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, তবে তা অন্তত ১৫ শতাংশ ভোট পাবে বলে মনে করেছেন অনেকেই।
সংস্কারের প্রশ্নে ৯৪ শতাংশ তরুণ একমত যে শিক্ষা খাত থেকেই পরিবর্তন শুরু করা দরকার। এরপর তরুণদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে স্বাস্থ্য খাত ৯২ শতাংশ, শ্রমবাজার ৯০ শতাংশ, মানবাধিকার ৮৯ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক শাসন ৮৫ শতাংশ এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা ৬৭ শতাংশ। তবে ৩.৯৯ শতাংশ মনে করেন তাদের অগ্রাধিকারগুলো জরিপে একেবারেই প্রতিফলিত হয়নি, আর ১২.১৩ শতাংশের মতে এগুলো খুব সামান্যই উঠে এসেছে।
জরিপে দেখা যায়, প্রস্তাবিত সংস্কার সম্পর্কে প্রায় অর্ধেক ৪৩.৫ শতাংশ তরুণ একেবারেই অবগত নয়। মাত্র ২.৩ শতাংশ দাবি করেছেন যে তারা এই সংস্কার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে জানেন।
কেকে/ এমএস