বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক স্থবিরতা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলনজনিত ব্যাঘাত এবং বৈশ্বিক শুল্ক অনিশ্চয়তার মাঝেও সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি আয় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়ে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও রফতানিকারক ও ব্যবসায়ী মহল দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করেছিল, তথাপি চলমান সংকটের মধ্যে এ অর্জনকে ‘উৎসাহজনক’ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সবচেয়ে বেশি আয় এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যা এককভাবে ৩৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তবে বছরের শেষ মাস জুনে এনবিআরের কর্মবিরতি ও ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটির প্রভাবে রফতানি আয় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ হ্রাস পায়, যা সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে কিছুটা ব্যাহত করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যমান জ্বালানি সংকট, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নতুন শুল্কনীতি এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দ্রুত সমাধান না হলে ভবিষ্যতে এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বুধবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয় করেছে- যা আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৪৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়নের তুলনায় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। তবে ইপিবির মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমস বিভাগের কার্যক্রম যদি পুরোপুরি সচল থাকত, তাহলে রফতানি আয় আরো বাড়তে পারত। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, জুনের শেষ দিকে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রফতানির সামগ্রিক আয়ে।
সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও দেশের রফতানি আয়ের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত। ইপিবি তথ্য অনুযায়ী, এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৩৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে নিট পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ; এ খাত থেকে আয় দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরে ছিল ১৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ওভেন পোশাক খাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
পাশাপাশি, হোম টেক্সটাইল রফতানি আয় ২ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭২ মিলিয়ন ডলারে এবং বিশেষায়িত টেক্সটাইল পণ্যের রফতানি ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৮২ মিলিয়ন ডলার।
তবে রফতানির মাসভিত্তিক চিত্রে ভিন্নতা দেখা গেছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে তৈরি পোশাক খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ কম। এর মধ্যে নিট পোশাক রফতানি ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ কমে হয়েছে ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার এবং ওভেন পোশাক রফতানি ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে।
অন্যদিকে, চলতি বছরের জুন মাসে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ কম। এর মধ্যে নিট পোশাক রফতানি হয়েছে ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যা ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ওভেন পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘রফতানি আয়ে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা ছিল, তবে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও খারাপ নয়- এটি আরো ভালো হতে পারত, যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রফতানিতে বিঘ্ন না ঘটত।’
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘নতুন অর্থবছরে আমরা ভালো দিনের আশা করছি। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে- বিশেষ করে জ্বালানি সংকট ও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য শুল্কহার নিয়ে অনিশ্চয়তা- যা সরকারের দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে যথাযথভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারলে আমরা রফতানির এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবো না। তবে নতুন করে যদি আর কোনো সংকট তৈরি না হয়, তাহলে আমরা মনে করি অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং রফতানি খাত হবে এর প্রধান চালিকাশক্তি’।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত অর্থবছরে নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও রফতানি প্রবৃদ্ধি ‘উৎসাহজনক’। সামনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কহার বৃদ্ধি এবং আগামী বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন।’
তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত শুল্কহার ৯০ দিনের জন্য মুলতবি করা হয়েছিল, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৯ জুলাই। এরপর কী হবে, সে বিষয়ে আমরা এখনো অনিশ্চয়তায় রয়েছি। অন্যদিকে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা হচ্ছে। যদি নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তাহলে তা ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
সামগ্রিক রফতানি আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকলেও সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রফতানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অস্থিরতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে বাংলাদেশ ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফানি আয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ কম।
রফতানিকারকরা বলছেন, গত জুনের প্রথম সপ্তাহে ঈদুল আজহায় দীর্ঘ ছুটির কারণে পণ্য রফতানি হয়নি। আবার মাসের শেষ দিকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে ২৬ ও ২৭ জুন আমদানি-রফতানি পুরোপুরি বন্ধ ছিল। মূলত, এ দুই কারণে জুনে পণ্য রফতানি কমেছে।
একজন পোশাক রফতানিকারক বলেন, ‘জুনের শেষ ভাগে পণ্য চালান দিতে আমাকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারণ, এনবিআরের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিলেন। এমনকি কিছু পণ্য সময়মতো পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছি। যেগুলো এখন জুলাইতে পাঠাতে হচ্ছে- এজন্য ক্রেতাকে ছাড়ও দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মতো অনেক রফতানিকারকই একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক রফতানির ওপর। শেষ পর্যন্ত রফতানি আয় দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি।’
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৯৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের ৯৬৪ মিলিয়নের তুলনায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৪৪২ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি আয় ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, আর প্লাস্টিক পণ্যের রফতানি আয় ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৪ মিলিয়ন ডলারে।
বিদায়ী অর্থবছরে চামড়ার তৈরি জুতা রফতানিতে ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৫৪৪ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭২ মিলিয়ন ডলার। তবে চামড়াজাত অন্য পণ্যের রফতানি ২ দশমিক ২১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫৪ মিলিয়ন ডলারে। এ ছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি ৪ দশমিক ১০ শতাংশ কমে ৮২০ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
নন-লেদার ফুটওয়্যার, যা দেশের একটি উদীয়মান খাত হিসেবে বিবেচিত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানিতে এ খাত ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ৫২৩ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪১৭ মিলিয়ন ডলার। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে ফার্মাসিউটিক্যালস খাত থেকে রফতানি আয় ৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৩ মিলিয়ন ডলারে।
কেকে/এআর