জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের রাজস্ব আদায়ে প্রধান সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও, দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষতায় বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। সংস্থাটির বিরুদ্ধে কর ফাঁকিতে সহায়তা, ঘুষ-দুর্নীতি, মিথ্যা মামলা দায়ের ও হয়রানি, শুল্ক জালিয়াতি, দুর্বল সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনা, কর্মদক্ষতার অভাব, আস্থাহীনতা ও প্রশাসনিক হয়রানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তথ্যভিত্তিক অডিট, অটোমেশন বা ই-সিস্টেমের মতো যুগোপযোগী উদ্যোগ থেকেও এনবিআর অনেকটাই পিছিয়ে। এমনকি বহু আগেই চালু হওয়া ই-টিআইএন, ই-পেমেন্ট, ই-ভ্যাটের প্রয়োগ এখনো পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।
সিপিডি, বিআইডিএসসহ কয়েকটি অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ও অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে এনবিআর পুনর্গঠনের দাবি জানালেও কার্যকর সংস্কার নিয়ে এখনো সন্দিহান। তবে এরইমধ্যে এনবিআরের আওতাধীন সব কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা করেছে সরকার। সোমবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা গতিশীল রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সংস্কার ও পুনর্গঠনের জোরালো দাবি থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার সেই কাঠামোগত সংস্কারে হাত দিতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে এনবিআরের একাংশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবি আদায়ের নামে নানা অজুহাতে তারা পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাকে অচল করে দেয় এবং অর্থনীতিকে ঠেলে দেয় এক নতুন সংকটের মুখে। অভিযোগ আছে, বাস্তবে এই প্রতিরোধের পেছনে ছিল স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে ঘুষ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ এনবিআরের প্রশাসনিক কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতির ও আমলাতান্ত্রিক। কর ফাইল নিষ্পত্তি, রিফান্ড, আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায় হয়রানি, অটোমেশন বিলম্ব ইত্যাদি কারণে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। এনবিআরের অদক্ষতা অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বাড়ছে, রফতানিতে প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে।
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও দেশের কর প্রশাসন এখনো রাষ্ট্রের আর্থিক কাঠামোকে টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেনি। এনবিআরের দুর্বল প্রশাসন, অব্যবস্থাপনা এবং ঘুষ-দুর্নীতি দীর্ঘকাল ধরে রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। অনেক ক্ষেত্রে, কর্মকর্তারা ঘুষ না পেলে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কর ফাঁকির মামলা করে হয়রানি করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে করদাতা ও ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগ নিয়মিতভাবে উঠে আসে। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এনবিআরের ৬ জন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে। অভিযোগ রয়েছে, গত ২০-২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চাকরিকালে তারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক, ভ্যাট ও কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে নিজেরা লাভবান হয়েছেন এবং রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। তারা হলেন আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম; নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার; অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা; অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা; অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু ও যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন এনবিআরের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি।
তবে এনবিআরের আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দুদকের কার্যক্রমে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় না; বরং আগে যারা গভর্নর ছিলেন, তারা অনেক সময় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এখন সেই ধারা বদলেছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘কেউ চাইলে ভাবতে পারেন, এই সময়ে অনুসন্ধান শুরু হলো কেন। তবে এনবিআর ও বন্দর বন্ধ-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে প্রতিদিন আমার কাছে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ নিয়ে এসেছেন হিসাব বন্ধ, বড় ক্ষতি হয়েছে ইত্যাদি। এটা কিন্তু একদম গ্রহণযোগ্য নয়।’
জাতীয় স্বার্থ-সংক্রান্ত সেবা বন্ধ করা চলে না উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এনবিআর হোক বা বন্দর, এসব তো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে রাজস্ব আসে। আপনি যদি একতরফাভাবে একটি সেবা বন্ধ করে দেন, সেটা জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী।’
আন্দোলনে যুক্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে উপদেষ্টা বলেন, ‘ভালো করে কাজ করুন। পক্ষপাত বা ভয় ছাড়া কাজ করতে হবে। জনসেবা যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে হয়, সেটা হলে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কেউ বিচ্যুতি ঘটালে জবাবদিহি করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক।’
গত এক সপ্তাহ ধরে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের জন্য আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠানটির সংস্কার ঐক্য পরিষদ। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় রোববার আন্দোলন প্রত্যাহার করে সংগঠনটি। ফলে গত শনিবার ও রোববার দুই দিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে গতকাল সোমবার সকাল থেকেই কাজে ফেরেন আন্দোলনে থাকা এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের অন্যান্য স্থলবন্দরগুলো।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, গত কয়েকদিনের আন্দোলনে ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হয়েছে। রাজস্ব আদায় হোঁচট খেয়েছে। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যা কিছু হয়েছে সব ভুলে গিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমরা সবাই কাজ করব। যে কাজগুলো আছে সেগুলো এগিয়ে নিয় যাব। আশা করি আমাদের আর এ ধরনের সমস্যার মধ্যে যেতে হবে না। অতীতে রেভিনিউ অফিসাররা যেভাবে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন, একইভাবে তারা কাজ করবেন।
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এনবিআরকে দুই ভাগে বিভক্ত করার জন্য যে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে, তা সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় ছিল এ কথা আন্দোলনকারীরাও অস্বীকার করবেন না। এখন মূল বিষয় হলো, এই অধ্যাদেশের বাস্তবায়ন কার্যকরভাবে এগিয়ে নেওয়া। সরকারেরও উচিত সেই দিকেই গুরুত্ব দেওয়া। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, নতুন দুটি বিভাগে এনবিআরের অভ্যন্তর থেকেই নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অধ্যাদেশে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এমনভাবে লেখা হয়েছে এতে প্রশাসনিক ক্যাডারের আধিপত্যের দরজাটা খোলা আছে।
ড. জাহিদ হোসেনের মতে, আন্দোলনের মূল কারণ যদি হয়ে থাকে এই নিয়োগপ্রক্রিয়া ও তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া, তাহলে আন্দোলন হওয়ার কথা ছিল সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে।
কেকে/ এমএস