সরকারের কঠোর অবস্থান ও দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের চলমান আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। টানা তিন সপ্তাহ ধরে চলা এই আন্দোলন দেশের অর্থনীতি, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম এবং রাজস্ব আদায়ে চরম স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে। কাস্টমস, বন্দরের সেবা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যেও নেমে আসে স্থবিরতা। অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় ধরে চলমান আন্দোলনকে ‘পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক’ আখ্যা দিয়ে জানিয়েছে, জাতীয় স্বার্থ ও নাগরিক সেবা রক্ষায় প্রয়োজন হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনতিবিলম্বে কর্মস্থলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একইসঙ্গে সংস্থাটির আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানিয়ে সরকার বলেছে, কাজে যোগ না দিলে দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হবে।
রোববার সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, অতি জরুরি আমদানি-রফতানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার এনবিআরের আওতাধীন সব কাস্টম হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস বা সেবা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রোববার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে এক বিবৃতিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার জানান, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে গত কয়েকদিনের কর্মসূচি তথা ২৮ ও ২৯ জুন যে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি-রফতানি তথা দেশের অর্থনীতিতে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তা নিরসনে দেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের উদ্যোগ ও আলোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই। অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে সরকার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারে যে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে সেটিকেও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ স্বাগত জানায়। হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার বলেন, এই কমিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে টেকসই রাজস্ব সংস্কারে অবদান রাখতে পারব বলে আমরা মনে করি। এমতাবস্থায় কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।
রোববার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে শেষে তিনি জানান, এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সংকট নিরসনের পথ খুঁজবে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এনবিআরের সব পদকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সেবা’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, যাতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
গত শনিবার ও রোববার আন্দোলনকারীরা দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করেন। এর ফলে বন্দরে কন্টেইনার খালাস, মূল্যায়ন ও কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে চরম বিপাকে পড়ে আমদানিকারক ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢাকা কাস্টমস, চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল, পেট্রাপোলসহ প্রধান কাস্টমস পয়েন্টগুলোয় হাজার হাজার কনটেইনার আটকে আছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, এই অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে তা পণ্যমূল্য, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব ব্যবস্থার এমন অচলাবস্থা শুধু স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব ঘাটতির কারণ হবে না, বরং বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও বাজেট বাস্তবায়নেও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। চলতি অর্থবছরে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার ৮৫ শতাংশের বেশি আদায় হওয়ার কথা এনবিআরের মাধ্যমে। এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে বাজেট বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
এদিকে এনবিআর সংস্কার ঘিরে কর্মকর্তাদের আন্দোলন এবং সার্বিক রাজস্ব সংস্কার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের পর রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।
এর আগে অন্তবর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে রোববার বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের কথা থাকলেও তা হয়নি। অর্থ উপদেষ্টার পক্ষ থেকে বলা হয় আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে আলোচনায় বসবেন না তিনি। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতারা।
এনবিআর কর্মকর্তা শফিউল বাসার বাদল জানান, আজ (রোববার) দ্বিতীয় দিনের মতো শাটডাউন ও মার্চ ফর এনবিআর কর্মসূচি চলাকালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়। এতে আমরাও আলোচনায় বসতে রাজি হই। পাশাপাশি এনবিআর’র কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। আমাদের ২০ জন কর্মকর্তা আলোচনার জন্যে সচিবালয়ে রওয়ানা দেন অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে পথিমধ্যে তারা জানতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা আলোচনায় বসবেন না। তিনি আলোচনার জন্য শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। সব ধরনের আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে নাকি তিনি আলোচনায় বসবেন না।
এদিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কার্যালয়ে দেশের বিভিন্ন কর-শুল্ক অফিস থেকে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। তবে ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি চলমান থাকবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে সরকারের জারি করা এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ গঠনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত অনুযায়ী এই আলাদা কাঠামো গঠনের বিষয়টি ছিল অত্যাবশ্যকীয়। যদিও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাঠামো বিভাজনে আপত্তি জানাননি, তবে তাদের দাবি নতুন বিভাগে রাজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
একইসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের পদত্যাগ দাবি করা হয়, যিনি আন্দোলনকারীদের মতে, সরকারের কাছে প্রকৃত তথ্য গোপন করেছেন এবং এ সংকট সৃষ্টির অন্যতম দায়ী।
প্রথমে আন্দোলন কিছুটা স্থগিত হলেও, ২৯ মে’র মধ্যে চেয়ারম্যান অপসারণ না করায় তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়। এরপর ২২ জুন পাঁচ কর্মকর্তাকে বদলি করায় আন্দোলন আরো জোরদার হয়।
কেকে/ এমএস