শুক্রবার, ২২ আগস্ট ২০২৫,
৭ ভাদ্র ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

শুক্রবার, ২২ আগস্ট ২০২৫
শিরোনাম: ফের পিএস বিতর্কে আসিফ      ভাগ পেতেন ডিসি-এসপিরাও      রাজস্ব খাতের নেতৃত্ব দেবেন অভিজ্ঞরাই      ইতা‌লির প্রধানমন্ত্রী মেলোনির ঢাকা সফর বাতিল      সাগর-রুনির পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হলো রাজউকের প্লট      মহানবী (সা.) এর সিরাতই তরুণদের চরিত্র গঠনের রোল মডেল: ধর্ম উপদেষ্টা       নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য জরুরি      
জীবনানন্দ
এবং মোটরসাইকেলের বিয়ে
ইউনুছার রহমান
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০২৫, ৯:১৫ পিএম

গল্পটা সেই আশির দশকের। তখন নওগাঁ জেলা শহরে কোনো মোটরসাইকেলের দোকান ছিল না। পত্নীতলা উপজেলায় কিছু অভিজাত পরিবারের লোক-জনের মোটরসাইকেল ছিল। এখন তো ঘরে-ঘরে মোটরসাইকেল। সে সময় নতুন জামাইকে একটা মোটর সাইকেল কিনে দেওয়া মানে আজকের দিনে হেলিকপ্টার কিনে দেওয়া। মোটর সাইকেল কিনতে গেলে অনেক কষ্ট করে এবং সময় ও টাকা নষ্ট করে বগুড়া জেলা শহরে যেতে হতো। অথবা, রাজশাহী বিভাগীয় শহরে।

চেরাগ আলী চেয়ারম্যান ধনাঢ্য, প্রভাবশালী ও উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি। বছরে ধান পান দেড় হাজার মন। ছেলে নেই। মেয়ে তিনটি। মলি। জলি। পলি। মলি সবার বড়ো। বিএ পাস। চেয়ারম্যান সাহেবের একান্ত ইচ্ছে মহা ধুমধাম করে মলির বিয়ে দেবেন। গোটা ইউনিয়নের সকলকে নেমন্তন্ন দিয়ে একবেলা পেট ভরে গোস্ত-ভাত খাওয়াবেন।
 
ঘুঘুডাঙ্গার পেশাদার ঘটক নেয়ামত আলীকে দইমুদ্দি দফাদার দিয়ে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। ‘এক মাসের মধ্যেই বড়ো মেয়ে মলির বিয়ে দেবো। ভালো পাত্র দেখো। সৎ পাত্রে কন্যাদান ধর্মীয় বিধান। ইঞ্জিনিয়ার। ডাক্তার। ব্যাংকার। জমিজমা থাকুক আর না থাকুক, ছেলেকে হতে হবে স্মার্ট, সুদর্শন, উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট। চাকরিজীবী হতে হবে অবশ্যই। কোনো বেকার ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেবার ইচ্ছে আমার নেই। কারণ, আমিও প্রাক্তন প্রফেসর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের। রস-যশ ও খ্যাতির আমার কমতি নেই।’

ঘটক বাহাদুর চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে ইচ্ছেমতো ভূরিভোজ সেরে নগদ দক্ষিণা নিয়ে ভাঙা ছাতা বগলদাবা করে পান চিবোতে চিবোতে মায়া বিড়ি পরম মমতায় ফুঁকতে-ফুঁকতে এবং তৃপ্তির ঢেকুড় তুলতে তুলতে সৎ পাত্রের সন্ধানে বের হলেন। ‘বাবারে বাবা। চেরাগ আলী চেয়ারম্যান বলে কথা। ভালো পাত্র জোগাড় করতে না পারলে খবর আছে। বাবার নাম ভুলিয়ে দেবেন!’

বাড়ি এসে তিনি তাঁর অধীনস্ত ও বিশ্বস্ত পাতি ঘটকদের ডেকে পাঠালেন। তখন তো মোবাইল ফোনের ‘ম’ ছিল না। অতএব ভাতিজা ভোলা ভাঙা দ্বি-চক্রযান নিয়ে বের হলো। চাচার বিশ্বস্ত চামচা সে। যা পকেটে পড়ে, তাতেই তার চলে। একমাত্র মানুষ। বউ ছিল। তার পুরুষত্বের মাথায় পদাঘাত করে পশ্চিম পাড়ার পলাশের সাথে পালিয়ে গেছে। যাক সে কথা।

পাতি ঘটকেরা একে একে এলেন। ভালো-মন্দ খেলেন। নেয়ামত আলী ঘটকের কড়া নির্দেশ ও বরের বর্ণনা মুখস্থ করতে-করতে তাঁরা ফটক পেরিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যিনি ভালো পাত্র জোগাড় করতে পারবেন, তাঁর জন্য বিশেষ বখশিস আছে। তাঁরা মনের আনন্দে বেসুরো-সুরে গান গাইতে গাইতে গতর খাটাতে লাগলেন। ‘যেমন করেই হউক সৎ পাত্র সন্ধান পূর্বক পুরস্কার পেতেই হবে।’

এভাবে একমাস কেটে গেল। নেয়ামত আলীর নিদ্রা হলো হারাম। পায়না কোনো কর্মে আরাম। পাতি ঘটকদের নেই কোনো দর্শন।

হরিপুরের হাফেজ ঘটক অনেক ঘেটে-ঘুটে একটা সৎ পাত্রের সন্ধান পেলেন। কাঠফাটা রোদে একদিন দুপুরে হন্হন্ করে নেয়ামত আলীর বাড়ি এলেন এবং হাঁপাতে-হাঁপাতে ছেলের যেভাবে বর্ণনা দিতে লাগলেন তাতে মনে হলো কেয়ামত পর্যন্ত খুঁজেও বুঝি এমন ‘বর’ পাওয়া যাবে না। ছেলে ম্যানেজার। জনতা ব্যাংকের জনপ্রিয় ম্যানেজার। বাপরে বাপ দিতে হবে ঝাঁপ...!

এবার ছেলে দেখা দেখির পালা। চেয়ারম্যান সাহেব ডজন খানেক গণ্যমান্য ব্যক্তি সঙ্গে করে বর দেখতে গেলেন। দুটো মোষের গাড়িতে চেপে। ঘড়ি ধরে সময় মেপে মেপে।

বর এক নজর দেখেই তাঁর নজরে লাগল। এবার মেয়ে দেখার পালা। ম্যানেজার সাহেবও তাঁর কতিপয় সহকর্মী ও আত্মীয়-স্বজন ম্যানেজ করে কনে দেখে এলেন। মেয়েটি তাঁরও মনে লেগেছে। এবার দেওয়া নেওয়ার পালা এবং এটাই বড়ো জ্বালা...!

নেয়ামত ঘটকই আগ বাড়িয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের সামনে ‘চাহিদার চিরকুট’ তুলে ধরলেন। একটা নতুন ঝকঝকে হানড্রেট সিসি মোটরসাইকেল। সেই সাথে হাত-কান-গলা মিলিয়ে পাঁচ ভরি বাইশ ক্যারেটের স্বর্ণালংকার। তবে মোটর সাইকেল দর্শন না করে বর মানে ম্যানেজার সাহেব ‘কবুল’ বলবেন না।
 
চেয়ারম্যান সাহেব কোনো প্রকার চিন্তা না করেই বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেলেন। সেই সময় ব্যাংকের একজন ম্যানেজার পাওয়া মানে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার করার মতো অবস্থা। এখন তো ম্যানেজারের মেলা বসেছে। কেউ রাখেনা খবর তাদের।
 
মেয়ের বরাত যেন ভালো হয়। সেই জন্য চেয়ারম্যান সাহেব শবেবরাতের রাতে বিয়ের সময় ধার্য করলেন। উনি নেয়ামত আলী ঘটককে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, বরযাত্রী যেন কোনো মতেই শতাধিক না হয়। বেশি হলে কিন্তু খবর আছে।
 
শুভদিনে শুভক্ষণে শুভকর্ম সম্পাদনের জন্য শ ছুঁই ছুঁই বরযাত্রী এলো। তখন মাগরিবের আজান দেয়-দেয়। যারা নামাজি তারা তড়িঘড়ি করে নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগল। আর বে-নামাজিরা বিড়ি-সিগরেট ফুঁকতে ফুঁকতে এবং খুক খুক করে কাশতে কাশতে গায়ে হাওয়া লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
 
নামাজ শেষ হলো। এবার নাস্তা-পানির পালা। এরপর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। মাওলানা এবং কাজী সাহেব সকাল থেকে ঝিম মেরে বসে আছেন। বিয়ে পড়ানো ও বিয়ে রেজিস্ট্রি করানোর জন্য। কিন্তু তখনো বগুড়া থেকে মোটরসাইকেল বাড়ি এসে পৌঁছায় নাই। চেয়ারম্যান সাহেব বারবার ঘড়ি দেখেন আর আরমান সেক্রেটারিকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে সোয়া সের ওজনের ধমক দেন। ধমক খেয়ে তাঁর কাপড় নষ্ট হওয়ার মতো অবস্থা!
 
‘কইরে আরমান, মোটরসাইকেল তো এখনো এসে পৌঁছুলো না। কী-যে করো তুমি। অকর্মার এক শেষ। পান খাও আর গান গাও পাজি ছেলে কোথাকার...!’

আরমান সেক্রেটারি সেকেন্ডের মধ্যে ছুটে আসেন। লাফাতে লাফাতে এবং হাঁপাতে হাঁপাতে। তাঁর আবার পাতলা পায়খানা। ঘন ঘন পুকুর পাড়ে যান।
 
‘স্যার, একটু সময়। এই আধা ঘণ্টার মধ্যে মোটরসাইকেল এলো বলে। প্লিজ স্যার, একটু ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ্ ধৈর্যশীলকে পছন্দ করেন। ইত্যাদি ইত্যাদি...।’

এভাবে আধা ঘণ্টা করতে করতে রাত আটটা বেজে গেল। মোটর সাইকেল আসে না। মলির বিয়েও হয় না। ‘কতক্ষণ আর কনে সেজে বসে থাকা যায়। বাবাটা যে কী...।’

বরপক্ষ পণ করে মন খারাপ করে বসে আছে। মোটর সাইকেল না দেখে মাননীয় ম্যানেজার ‘কবুল’ বলবেন না। কে যেন বলেছেন, ‘চেরাগ আলী চেয়ারম্যান হাড় কিপটে। মোটর সাইকেল না-ও দিতে পারেন। বিধায়, ‘নো মোটর সাইকেল নো বিবাহ।’

পিঠাপিঠি দুবোন ও বান্ধবীরা যতোই মলিকে সান্ত্বনা দেয়, ততোই ও নাকের জলে ও চোখের জলে গাল ভাসায় আর গাল খায়। মোটরসাইকেল আসতে দেরি করায় ওর মনটা ব্যথায় টন্টন্ করে। বাবা একবার বাইরে যান। একবার বাড়ির ভেতরে আসেন। চেঁচামেচি করেন। পাগলের মতো ছুটোছুটি করেন। ইউনিয়ন পরিষদের সেক্রেটারি আরমানকে বুঝি লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়ে পরপারে পাঠান। কারণ ওর ওপরই মোটরসাইকেল কেনার দায়িত্ব ছিল। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে চাকরি নট!

যাই হোক। মোটরসাইকেল মোটরসাইকেল করে বরপক্ষ ও কনেপক্ষের মধ্যে প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপর চেয়ার দিয়ে মারামারি। শেষে এক কুরুক্ষেত্র বেঁধে গেল। কে যে কাকে মারে কিছুই বোঝা যায় না।
 
চেয়ারম্যান সাহেবের দু-চোখ তো চড়কগাছ! যতোই বলেন, ‘থামুন-থামুন’, ততোই আরো ধাক্কা-ধাক্কি, মারা-মারি বেড়েই চললো। কারো মাথা ফাটলো। কারো কান কাটল। কারো ভাঙল হাত। কারো ফাটলো নাক। যারা মারামারিতে মোটেই দক্ষ নয় তারা লুকিয়ে প্রাণ বাঁচালো। কে শোনে কার কথা আর কে বোঝে কার ব্যথা! এমন ঘটনা পত্নীতলা উপজেলায় এই প্রথম। পত্নী পাগল পতিরা পরবর্তীতে খবরটি শুনে গুণে গুণে দেখল যে, এমন ঘটনা তো ইতঃপূর্বে ঘটে নাই। এবং আগামীতেও ঘটবে কি না সন্দেহ।
 
রাত নটা বাজে বাজে। এমন সময় দেখা গেল মোটরসাইকেলের হেড লাইটের ক্ষীণ আলোকচ্ছটা। সবার কান হলো খাড়া। চোখ হলো ছানাবড়া!

উল্কার গতিতে ছুটে আসছে হানড্রেট সিসির মোটরসাইকেল। ‘ছি! ছি! সামান্য একটা মোটর সাইকেলের জন্য’ চেয়ারম্যান সাহেব আর ভাবতে পারেন না। মাথার তালুতে তেল মালিশ করে কুড়ি বছরের কর্মঠ কাজের বেটি বিধবা কারিমা।

অবশেষে মার খাওয়া এবং মারের ভয়ে লুকিয়ে থাকা বরণীয় বরযাত্রীবৃন্দ ভেজা বেড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে চুপি চুপি সামিয়ানার নিচে এসে ভয়ে ভয়ে চেয়ার দখল করতে লাগল। এখনো পেটে ভাত ভরেনি। ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে পাকস্থলী। তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে কলিজা। এক কেমন বিয়ে রে বাবা...!

বেজে উঠল বিয়ের সানাই। অন্দরের মহিলাদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল বাঁধভাঙা আত্রাই নদীর মতো। কিন্তু বিপত্তি ঘটালো চেয়ারম্যান সাহেবের দুই কন্যারত্ন। জলি আর পলি। ‘মোটরসাইকেল নিয়ে যেহেতু মন দরে মন কষাকষি সেহেতু হবু দুলাভাইকে আগে মোটরসাইকেলকেই বিয়ে করতে হবে। শর্তে রাজি না হলে নাকে খত দিয়ে এবং কানমলা হজম করে বউ ছাড়ায় বাড়ি ফিরতে হবে।’

ম্যানেজার সাহেব হবু শ্যালিকা দ্বয়ের শর্ত নিঃশর্তভাবে মেনে নিলেন। মুখে রুমাল চেপে।

কেকে/এএম
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ফের পিএস বিতর্কে আসিফ
ভাগ পেতেন ডিসি-এসপিরাও
রাজস্ব খাতের নেতৃত্ব দেবেন অভিজ্ঞরাই
কুমিল্লায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে যুবক নিহত
খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে শ্বশুরের বিরুদ্ধে পুত্রবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ

সর্বাধিক পঠিত

মদনে স্ত্রীর নির্যাতন মামলায় সাবেক কমিশনার গ্রেফতার
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কৃষি সংস্কার ও খাদ্য নিরাপত্তার অভিযাত্রা
জয়পুরহাটে বজ্রপাতে আলু ব্যবসায়ীর মৃত্যু
জামালপুরে পূবালী ব্যাংকের সহযোগিতায় আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন
‘আমি সিক্স পার্সেন্টে কাজ করেছি’, উপদেষ্টা আসিফের প্রেস সেক্রেটারির অডিও ফাঁস
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close