আমেরিকার মহাসাংস্কৃতিকতার পটভূমিতে নিজেদের সাংস্কৃতিক সত্তাকে হারিয়ে না ফেলে বাংলাদেশের এক ধরনের জাতীয় সাংস্কৃতিকতার আবহে বেঁচে থাকা মানুষদের উজ্জীবিত রাখা এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। তাদের আয়োজনে কখনো কখনো বাংলাদেশ বা ভারত থেকে দু-একজন বিশিষ্ট অতিথিকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়। তবে আমেরিকায় অভিবাসী যারা নজরুল চর্চা (মানে ঘুরেফিরে কয়েকটা মাত্র গান গাওয়ার কণ্ঠ কসরতের চেষ্টা, কিছু চেনা কবিতার ভিত্তিতে নজরুল ব্যবহৃত শব্দের তাৎপর্য অনুভব করতে না পারা- কৃত্রিম কণ্ঠের প্রক্ষেপণ) অব্যাহত রেখেছেন তাদেরই প্রতিনিধিত্ব থাকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। তবু মানতেই হবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিকতায় নিজেদের সত্তাকে হারিয়ে থাকা পরিবেশে এই ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে খুবই প্রশংসাযোগ্য কাজ!
২. কিন্তু নির্মোহভাবে আমাদের এই বিবেচনাও থাকা জরুরি যে, অনুশীলনের গভীরতা আয়োজনে যতটা গুরুত্ব পাওয়া সংগত তার চেয়ে বেশি অংশগ্রহণের দেখনদারিত্ব যেন বেশি মাত্রা না পায়। অগভীর অভিপ্রায়ে আমাদের প্রায় নিঃসংশয় সন্তোষ বোধের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও আমেরিকাবাসী নজরুলপ্রেমী বাঙালিদের একটি বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে। সেটি হলো, এখানকার অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি নর্থ রিজে ও কানেকটিকাট ইউনিভার্সিটিতে ‘Nazrul Endowment Research Studies’ চালু করতে পারা। নিঃসন্দেহে এই কর্মসূচি কিছু মাত্রায় হলেও কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও দর্শনকে আন্তর্জাতিক বিদ্যায়তনিক পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এগুলো উন্মোচন করছে গবেষণা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণে নতুন দিগন্ত, যা নজরুলের অবদানকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে হয়তো একদিন ভালোভাবে সহায়ক হয়ে উঠবে। তাই এমন উদ্যোগের প্রশংসা না করে উপায় নেই।
৩. বাংলার সৃজনশীলতার ভুবনে নজরুলের আবির্ভাবের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, বিশ্বসাহিত্যের মঞ্চে তিনি এখনো একেবারেই অপরিচিত। আন্তর্জাতিক পরিসরে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংগীতের দুনিয়ায় নজরুলকে আমরা সামান্যও চিনিয়ে দিতে পারিনি। নজরুলের বিকাশের কালে বাংলা অঞ্চল ঔপনিবেশিক নিগড়ে বদ্ধ থাকার সূত্রে এই অপরিচয়ের কারণ সহজেই অনুমেয়; কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরে দেশে দেশে বাংলাদেশের অনেকেই পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়েছেন, গবেষণা করেছেন, কিংবা পড়িয়েছেন এমনকি গবেষণাও করিয়েছেন; কিন্তু নজরুল-সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব, বিদ্রোহ, প্রেম, দর্শন কিংবা সমাজবোধ অন্য ভাষার সেরা কবিদের সঙ্গে তুলনা করে তেমন কেউ পরীক্ষা করে দেখেননি। ফলে বিশ্বসাহিত্যে তার অবস্থান কোথায় তা ভালোভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি আজও!
৪. রবীন্দ্রনাথ নিজে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় বিচরণ করেছেন, বুঝতে চেষ্টা করেছেন নিজের অবস্থান, ফলে পাশ্চাত্যে তার সম্পর্কে কিছুটা কৌতূহল জেগেছিল। এশিয়ানদের মধ্যে তার প্রথম নোবেল পুরস্কার পাওয়া এরই ফল বলা যায়! রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিস্তারের এই মনোভঙ্গিকে একটু তির্যকভাবেও দেখে বাঙালি সাহিত্য রসিকদের একটা অংশ। তাদের তির্যক বাক্য নির্দেশ করে যে, এখন রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে পাশ্চাত্যে কৌতূহল সে কারণেই অনেক কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও হয়তো মানতে হবে, পাশ্চাত্য সাহিত্য দুনিয়ায় তার উপস্থিতি এখনো অস্তিত্বশীল। কারণ এই ভুবনের মানুষের নিজস্ব কৌতূহল থেকেই রবীন্দ্র সৃষ্টিকর্মের সামান্য সন্ধান ও চর্চা তারা করেছেন। আমাদের মনে পড়বে তার সমকালে একসময় ডাব্লিউ বি ইয়েটস, হ্যারিয়েট মনরো, এজরা পাউন্ড, রোমাঁ রলাঁ, আঁদ্রে জিদ, ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর মতো বিশ্ববিশ্রুতরা কৌতূহলী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সামগ্র্যের প্রতি। নজরুলের ব্যাপারে তেমন প্রায় সামান্যও উল্লেখ করা যায় না। এক সময় রুশদেশে দু-একজনকে কৌতূহলী হতে দেখা গিয়েছিল। ইয়োরোপেও হয়তো সামান্য কৌতূহল পাওয়া যাবে। অন্তত উপনিবেশ-উত্তর কালে নজরুলের ব্যাপারেও পাশ্চাত্যের সাহিত্য মহলে তার সম্পর্কে কৌতূহল জাগানো আরো কিছুটা হলেও সম্ভব ছিল। ব্রিটিশ উইলিয়াম র্যাডিচে বা আমেরিকান ক্লিনটন বি সিলি যেমন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও মাইকেলের ব্যাপারে সাহিত্যিক কৌতূহল থেকে তাদের নিয়ে চর্চা করেছিলেন তেমনি চর্চা নজরুলকে নিয়ে হয়ইনি প্রায়। এরা দুজনই নজরুলকে সামান্য ছুঁয়ে গেছেন মাত্র! অনেক পরে প্রায় সাম্প্রতিক কালে আমেরিকায় আমরা পেলাম উইন্সটন ই ল্যাংলিকে! ল্যাংলি সাহিত্যের রসিক নন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তাই তিনি নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি নজরুলকে। তার প্রথম গবেষণার বইরূপের নাম ‘Kazi Nazrul Islam: The Voice of Poetry and the Struggle for Human Wholeness’। তিনি আমেরিকার জার্নালেও নজরুলকে নিয়ে বিদ্যায়তনিক রচনা লিখেছেন। উপর্যুক্ত বইটিতে তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কেন নজরুলকে বিংশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং মানবাধিকার-সংগ্রামী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। তার মূল্যায়নের ভিত্তি দর্শন, নন্দনতত্ত্ব নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের বিরুদ্ধে নিজে মুসলিম হয়েও নজরুলের লড়ার ব্যাপারটি তাকে স্পর্শ করেছে; ল্যাংলি গভীরভাবে অনুভব করেছেন, এই এলাকার জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে নজরুলের তীব্র সমর্থক সত্তাকে। এর জন্য ব্রিটিশদের হাতে নজরুলের কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনাকেও ল্যাংলির সংবেদী মন আমলে রেখেছে। তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছেন, বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য নজরুল এক দৃঢ় কণ্ঠস্বর- যিনি সর্বত্র সন্ধান করেছেন মানুষের সম্পন্ন বিকাশের।
ইউরোপ যখন অমানবিক নির্যাতন, গণহত্যা ও ইতিহাসে অদৃষ্টপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞে নিমজ্জিত, সেই সময়, হাইস্কুলের গণ্ডিও শেষ করতে না-পারা, উপমহাদেশের সামাজিক অভিজাতদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, দারিদ্র্যে দগ্ধ এই মুসলিম সন্ধান করেছিলেন লিঙ্গ, ভূগোল, বর্ণ, জাতিসত্তা, ধর্ম, সামাজিক উৎস, ভাষা ও জাতীয়তার বিভাজন অতিক্রম করে মানব মর্যাদা রক্ষার জীবনাকাক্সক্ষার এবং মানবজাতির ঐক্যের। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বলে এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত পটভূমির মানুষ বলে ল্যাংলির নজরুল আবিস্কার এগিয়েছে স্বতন্ত্র পথে!
৫. উইনস্টন ল্যাংলির চর্চা নিঃসন্দেহে আমাদের ভাবায়। তবে বলতে গেলে উপর্যুক্ত বইটি পাশ্চাত্যের সাহিত্য সমাজে প্রায় পৌঁছায়ইনি। বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বলে পাশ্চাত্য সমাজ বইটির দিকে তাকায়ইনি প্রায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হলেও সাংস্কৃতিক পরিশীলনের দিক থেকে নজরুল ইনস্টিটিউটের সম্পাদনা ও প্রকাশনার নিম্ন মান এর জন্য অনেকটা দায়ী। বইটি যদি পাশ্চাত্যের যে কোনো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বা একাডেমিক বইয়ের জন্য পরিচিতি আছে এমন কোনো প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হতো তাহলে সম্ভাবনা থাকত এই বইয়ের মাধ্যমে নজরুলের অধিকতর সমাদর পাবার। কারণ একাডেমিক পুস্তক প্রকাশকেরা যেমন প্রকাশনার উন্নত সংস্কৃতি অনুসরণ করে থাকে তেমনি সন্ধান করে উপযুক্ত পাঠকেরও। নজরুল ইনস্টিটিউটের বইয়ের গন্তব্য সীমিত থাকবে সাধারণত ভক্ত নজরুলপ্রেমী বাংলাভাষীদের মধ্যে। ভিন্ন সংস্কৃতির কাছে হয়তো পৌঁছবারই অবকাশ পাবে না!
৬. নজরুকে নিয়ে ‘Nazrul Islam: Moral Courage and Truthfulness’ নামে আরেকটা বই লিখেছেন উইনস্টন ল্যাংলি। নজরুল রচিত একটি অপরিচিত ছোট্ট নাটকের ওপর ভিত্তি করে লেখা এই বইটি; এখানে ব্যক্তিজীবন ও সামষ্টিক জীবনের সুস্থতা ও কল্যাণে সত্যনিষ্ঠার অপরিহার্য গুরুত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ল্যাংলি এই বইয়ে বলেছেন, সামাজিক ও জনজীবনে সত্যনিষ্ঠার স্বীকৃত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও এর প্রকৃত অনুপস্থিতির কারণ হলো- মানুষ তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে এ মূল্যবোধকে ধারণ করার নৈতিক সাহসের অভাবে ভোগে।
রাজনীতি, ধর্ম, ক্রীড়া ও সামাজিক আন্দোলনের নানা ঘটনাপ্রবাহ থেকে নৈতিক সাহসের উদাহরণ এবং এর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে। হিটলারের মুখোমুখি হওয়া ডিটরিশ বোনহোফার, অলিম্পিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিমোন বাইলসের অবস্থান, আর্জেন্টিনার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মাদারস অফ দে প্লাজা দে মায়োর প্রতিবাদ, কিংবা পেন্টাগন ও মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে ড্যানিয়েল এলসবার্গের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এখানে।
কিভাবে কোনো বিশেষ খ্যাতি নেই এমন একজন ব্যক্তির জীবন ও কাজকে কেন্দ্র করে লেখা একটি ক্ষুদ্র সাহিত্যকর্মও সার্বজনীন গভীর তাৎপর্য বহন করতে পারে তা দেখায় বইটি। বইটি আরো দেখায়, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ বা অখ্যাত ব্যক্তিও মহান নৈতিক সাহস প্রদর্শনে সক্ষম। নৈর্ব্যক্তিক মনোভঙ্গিতে নজরুলের প্রতিভার মহত্ত্বকে দেখানো সহজ হয়েছে লেখক ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে রচনাকে বিশ্লেষণ করে এর তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন বলে!
নজরুলের ছোট্ট ও একটি অপরিচিত রচনাকে ভিত্তি করে লিখলেও ল্যাংলি এই বইয়ের মধ্য দিয়ে অনেক গভীরে পৌঁছেছেন নজরুল সত্তার! কিন্তু নজরুলেরই দুর্ভাগ্য বলতে হবে, এই বইটি যদিও প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকা থেকেই, কিন্তু এমন এক প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশনাসংস্কৃতিতে যে সংস্থার তেমন সুনাম নেই, যে সংস্থাটির কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে বড়জোর একে একটি ভ্যানেটি প্রেস বলা যাবে। এমনকি বইটি প্রকাশে হয়তো লেখকেই অর্থায়ন করতে হয়েছে। না সংস্থাটির বিদ্যায়তনিক বই প্রকাশে সাংস্কৃতিক দক্ষতার সুনাম আছে, না আছে বিদ্যায়তনিক বইয়ের জগতে প্রবেশাধিকারের যোগ্যতা! ইউনিভার্সিটি প্রেসগুলো একটি পাণ্ডুলিপির বইরূপ দেয়ার ব্যাপারে যে মাত্রায় পিয়ার রিভিউর মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকে, প্রকাশনার বিভিন্ন পর্যায়ে অজস্র সমস্যা ও জিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধান করে নিñিদ্র করে তোলার চেষ্টা করে তাতে তাদের প্রকাশিত বইয়ের প্রতি বিদ্যায়তনিক মহল অন্তত প্রাথমিক কৌতূহল প্রকাশ করে থাকতে পার।
৭. বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিকতায় নজরুল চর্চায় অক্ষম ভালোবাসাই এখনো প্রধান হয়ে আছে। সক্ষমতার আকাক্সক্ষাও এখনো জাগেনি আমাদের মধ্যে। নজরুল তার জাতির মধ্যেও ছিলেন শত শত বর্ষের দু-একটি ব্যতিক্রমের একটি। তাঁর মতো সত্তাকে বিশ্বসাংস্কৃতিকতায় পৌঁছাতেও হয়তো আমাদের শতবর্ষ অপেক্ষা করতে হবে তারই মতো কোনো প্রয়াসী সত্তার জন্য!
কেকে/এমএ