বরিশাল শহরের এক ব্রাহ্ম পরিবারে ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন এক শিশু। যার ডাক নাম ছিল মিলু। সমাজসেবক ও শিক্ষক বাবা সত্যানন্দ দাশের শ্যামল সৌন্দর্যমণ্ডিত ঘর হয়ে উঠে প্রাণচঞ্চল। মা কবি কুসুমকুমারী দাসের সানিধ্যে সাহিত্যচর্চা শুরু হয় অল্প বয়সেই।
বরিশালের বিস্তৃত ধানখেত, নিভৃত ঘর, সন্ধ্যার আলো-আঁধারি রঙ দাগ কেটে যায় ছোট্ট মিলুর হৃদয়ে। ছোট ছোট অক্ষরে ছন্দ সাজানোর চেষ্টা শুরু তখন থেকেই। হবেই বা না কেন? বাড়িতে তখন সাহিত্য চর্চা ছিল নিয়মিত। কখনো শিশির ভেজা ঘাসে বসে, কখনো কাকের ডাকে মুগ্ধ মিলু ছন্দ আর শব্দের খেলায় ডুবতে থাকে।
চারপাশের জগৎকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে মিলু। তাইতো তার প্রথম লেখায় উঠে আসে -ধানখেতের দোলো হাওয়া, শিউলির গন্ধ, কাশফুলের সুভাষ। কবি গ্রামের সাধারণ জীবন কেই ধারণ করেন লেখার প্রধান উপকরণ হিসেবে। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তিনি প্রতিদিন পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের কণ্ঠে শুনতেন গান। চারপাশের জগৎ যেন হাত ছাঁনি দিয়ে ডাকছিল মিলুকে। আগামী প্রজন্মের শুদ্ধতম কবি হওয়ার আহ্বান কি ছিল সেই হাতছানি তে! এই সেই ছোট মিলু যে একদিন হয়ে উঠে আধুনিক যুগের অন্যতম কবি। রূপসী বাংলার কবি খ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ।
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল তিরিশের দশকে। এই আধুনিকতার সেতু নির্মাণে জীবনানন্দের অবদান অবিস্মরণীয়। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে যখন কবিতা প্রচলিত ধারা থেকে মুক্তি খুঁজছিল, তখন জীবনানন্দ নিজস্ব ভঙ্গিমায় সেই পথ খুলে দেন। তার কবিতা শুধু শব্দ নয়; তা চিন্তার আলো, দর্শনের ছোঁয়া এবং মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে স্পর্শ করে। মানুষের মনে সাড়া জাগায় গভীর থেকে। জীবনানন্দের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় মায়ের কাছে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করান হয়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দু’বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পূর্বের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান; অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ঐ বছরই ব্রহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ ছাপা হয়।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কলেজের অধ্যাপনা করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯২৭-১৯৫৩ সালের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বেকারত্বের কারণে দুবার তিনি ইনস্যুরেন্সের চাকরিও করেন। তার চাকরি জীবন মোটেই মসৃণ ছিল না। নির্দিষ্ট কোনো চাকরি না থাকায় কবির চাকরিজীবন ছিল ভবঘুরের মতো এবং কবির দারিদ্র্য জীবনের অন্যতম কারণ ছিল এটি। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। যেখানে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু তিনি দ্রুত স্বকীয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে তার দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)‘তে তার স্বকীয় কাব্য কৌশল পরিস্ফূট হয়ে ওঠে। তিনি এক মৌলিক ও ভিন্ন ধারার জগতে প্রবেশ করান সাহিত্যকে। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মে তিনি ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন।
কবির বেকারত্বের সময় লাবণ্য দাশের শিক্ষকতা পেশাই ছিল জীবন ধারণের উপকরণ। জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবদ্দশায় কবি তার লেখার খুব বেশি স্বীকৃতি পাননি। চিরকালীন মমতার সঙ্গে সোঁদা মাটি, ঘাস-ফুল, নদী প্রভৃতির কাছে কবির বারবার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। চিত্ররুময়ী কবি বারবার ফিরতে চেয়েছেন সেই ধানসিঁড়িটির তীরে। নানান বেশে নানান সময়ে কবি ফিরতে চান তার প্রিয় রূপসীর কাছে।
সারাজীবন যেই কবির চিত্ররূপ আমাদের আনন্দিত করে চলেছে; বারবার ফিরে আসার আকুতি যার, তার জীবন মোটেই সুখকর ছিল না। কবির জীবন ছিল দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত। দুঃখকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে করতেই কবির লেখায় উঠে এসেছে সেসব অতৃপ্তি। গেঁয়ে গেছেন ক্লেষ্ট মানুষের জীবনকথা। অনুভব করে ধারণ করেছেন মানবজীবনের ভাবনা। সেসব ভাবনার ব্যাপকতা ছিল গভীর। ছিল বহুমাত্রিক। যিনি তার লেখায় কাল ও সময়কে ধরেছেন সচেতনভাবে।
সেই উপলব্ধিতে কবি লিখেছেন, ‘‘আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে; স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়”। ধূসরতার কবি সারাজীবন কেঁদেই গেলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো কবির খুব কঠিন ছিল। নানান ঘাত প্রতিঘাতে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করেছেন দুঃখের কবি জীবনানন্দ দাশ। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক হুমায়ূন কবিরের কাছে জীবনানন্দ দাশের পরপর লেখা তিনটি চিঠিই তার প্রমাণ দেয়। ঐ চিঠিগুলোতে কবি বারবার একটা চাকরি খুঁজেছেন। বিনীত চিত্তে বারংবার নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে একটা কিছু ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে গেছেন। দ্বিতীয় চিঠিতে কবি বলেন, “ভাগ্য এমনি যে, আজ আমার পেটের ভাত জুটছে না। কিন্তু, আশা করি, একটা দিন আসবে, যখন খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।
সত্যিই তাই হলো। আমরা পারিনি তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে। বাঙালি খাঁটি হিরা চিনতে বড্ড দেরি করে ফেলল।
কবি বলেছিলেন, আমার আর্থিক অবস্থাটা এখন এতটাই শোচনীয় যে, যে কোনো একজন সকর্মক ‘অপর’ মানুষ যে কাজ করতে পারে, আমারও তা পারা উচিত!’’ একজন মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন ছিল তা উপলব্ধি করতে এই কথাগুলোই যথেষ্ট। কবির জীবন ছিল সত্যিই ক্লান্ত আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’
১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ সালে কলকাতার ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন জীবনানন্দ দাশ। সাহিত্যিক সজনী কান্ত দাশের অনুরোধে তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যদিও এতে তার তেমন উন্নতি হয়নি। জীবনানন্দ দাশের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হন নিউমোনিয়ায়। ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে বাংলার বুক থেকে ঝরে পড়ে এক শুদ্ধতার কবি। তিমির হননের কবি অন্ধকারে পাড়ি জমালেন চিরতরে। অকালমৃত্যুর আগে জীবনানন্দ দাশ নিভৃতে ২১টি উপন্যাস ও ১০৮টি ছোট গল্প লেখেন, যার একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। জীবিকার কোনো সুস্থির পথ না থাকায় কবি আমৃত্যু সংগ্রাম করেই বেঁচেছেন। জীবনানন্দ গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দসহ কেউ কেউ ধারণা করেছেন আত্মহত্যার স্পৃহা ছিল জীবনানন্দের ট্রাম দুর্ঘটনার মূল কারণ।
গত একশ বছরে কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। আর তিনিই আমাদের জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন, জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তার জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি নাকি প্রায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কবি হলেও গ্রামবাংলার উপাদান-উপকরণ তার কাব্যে পেয়েছে স্বচ্ছন্দ প্রবেশ অধিকার। নিসর্গ চেতনায় ইতিহাসবোধের অনুপ্রবেশ ও সঞ্চার ঘটেছে সমান তালে। নির্জনতার কবি কি নির্জনেই রয়ে গেল? যার প্রতিটি পঙ্ক্তি আমাদের ভাবায়, আনন্দ দেয়, অনুভূতি প্রকাশে সহয়তা করে তাকে নিয়ে কতদূর ভেবেছি আমরা? আমরা কি অনুভব করি কবির কষ্টে জর্জরিত সেসব দিন। জীবনানন্দের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য প্রকৃতি ও মানবচেতনার মিলন। যা পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। তার কবিতায় দর্শন ও প্রতিফলন মিলিত হয়েছে নিপুণভাবে। তার অন্যতম উদাহারণ বনলতা সেন কবিতা। নীরব গ্রামীণ পরিবেশ, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ, কাশফুলের সোনালি আলো, এসব লেখা যেন একেকটা গবেষণার প্রতিফলন। কবিতায় সময়, মৃত্যু এবং একাকীত্বের অনুভূতিও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি, যা পাঠককে শুধুমাত্র আবেগিক নয়, বৌদ্ধিকভাবে ভাবতে প্রলুব্ধ করে। জীবনানন্দের জীবনও ছিল তার কবিতার মতোই গভীর ও রহস্যময়। তার শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বোধ, দর্শন ও চিন্তার গভীরতা বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের চিরকাল আর্কষণ করে গেছে।
আধুনিক কবি, শুদ্ধতম কবি, নির্জনতার কবি, ধূসরতার কবি, দুঃখের কবি, রূপসী বাংলার কবি.. কত নামেই আমরা তাকে ডাকি। কিন্তু মানবজীবন নিয়ে কবির যে দর্শন, গবেষণা, একনিষ্ঠতা ছিল তার রূপায়ন কিসে করব আমরা! সারাজীবন মানব জীবনকে উপলব্ধি করেছেন দর্শন বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত কবি তার লেখায়। তিনি শুধু কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন চিন্তা ও দর্শনের প্রতিফলনশীল একক যাত্রী।
কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় যে সময়টা ধারণ করতে চেয়েছেন তা একাধারে বর্তমান ও ভবিষ্যতের। এ কারণে তার লেখার সব উপজীব্য দূর ভবিষ্যতেও থাকবে প্রাসঙ্গিক। প্রতিটি লেখা যেন বর্তমান। প্রতিটি মানব মনের দর্শন, অনুভূতি যেন আজো আটকে আছে সেই সময়ে; জীবনানন্দের পঙ্ক্তিতেই আটকে আছি আমরা। থাকবে হয়তো বহু প্রজন্ম।
কেকে/এমএ