‘দিনের ভোট রাতে’, ‘ডামি’ ও ‘প্রহসনের নির্বাচনের’ মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করার অভিযোগে এবার রাষ্ট্রদ্রোহের ধারায় মামলার মুখোমুখি হয়েছেন দেশের তিন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কেএম নূরুল হুদা এবং কাজী হাবিবুল আউয়াল এই তিনজনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় নতুন করে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যুক্ত করা হয়েছে।
অতিসম্প্রতি রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় দায়েরকৃত মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহের ধারা সংযুক্তির আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করেন। আদালত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বৃহস্পতিবার এই তথ্য নিশ্চিত করে।
তথ্য বলছে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ইসির অধীনে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, যেখানে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হন। কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে, যেটি ‘দিনের ভোট রাতে’ দেওয়ার অভিযোগে দেশজুড়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।
অন্যদিকে ২০২২ সালে দায়িত্ব নেওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশন ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করে। তার আমলের নির্বাচনও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকটে পড়ে এবং বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাত্র এক মাস পর হাবিবুল আউয়ালসহ কমিশনের অন্যান্য সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন।
এর আগে গত ২২ জুন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহ উদ্দিন খান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলাটি করেন। অভিযোগে বলা হয়, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এই তিন সাবেক সিইসি সরকারি প্রভাব ও রাজনৈতিক সুবিধার জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রহসনের নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। এতে করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট এবং গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেছে। মোট ২৪ জনের বিরুদ্ধে করা মামলায় বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন এবং সরকারের পক্ষে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২২ জুন পুলিশ কেএম নূরুল হুদাকে গ্রেফতার করে। পরদিন ২৩ জুন আদালত তাকে চার দিনের রিমান্ডে দেন। পরবর্তীতে ২৫ জুন রাজধানীর মগবাজার থেকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতার করে। তাকে ২৬ জুন সিএমএম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। যদিও কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এখনো অধরাই আছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নানা বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেওয়া কর্মকাণ্ডেরই ধারাবাহিকতায় আজ তাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার এবং রিমান্ডের মতো কঠোর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। যা তাদেরই অপকর্মের ফল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন, ভোটারবিহীন জয়, বিরোধী দলকে প্রান্তিক করে দেওয়া নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা সংকট তৈরি করেছে। সেই অতীতের ‘নির্বাচনি ব্যর্থতা’ কিংবা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতের অভিযোগ তাদের জন্য আইনি জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গতকাল আদালতের শুনানিতে হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমার জীবনে কোনো অর্থ আত্মসাৎ কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। আমি স্বীকার করছি, আমাদের সময়ে অনেক নির্বাচনে ভোটারবিহীন ‘ডামি নির্বাচন’ হয়েছে। কিন্তু এতে কমিশনারদের একক দায় নেই। আমাদের হাতে বিকল্প কোনো পথও ছিল না। তবে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হচ্ছে তিন সাবেক সিইসি পরিকল্পিতভাবে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
‘ক্ষমতার লোভ শেখ মুজিবও সামলাতে পারেননি’ মন্তব্য করে কাজী হাবিবুল আউয়াল এ সময় নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব তুলে ধরে বলেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী ১ হাজার বছরেও এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আউয়াল পূর্বের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে বলেন, ৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত ৭৩ এর নির্বাচনে আ.লীগ ২৯৩টি আসন পায়। সেই নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। ক্ষমতার লোভ এমন যে, শেখ মুজিবও তা সামলাতে পারেননি। ৯৬ সালে আ.লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে। পরবর্তী সময়ে তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সংবিধান সংশোধন করে।
এ সময় পাবলিক প্রসিকিউটর উত্তেজিত হয়ে আদালতকে বলেন, তিনি নিজেকে জাস্টিফাই করছেন। তার এসব বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। এসময় আউয়াল বলেন, জাস্টিফাই না করতে দিলে রিভলবার দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন। এসময় উপস্থিত আইনজীবীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলে এজলাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, প্রসিকিউশনের বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। নির্বাচনটি ডামি ও প্রহসনের নির্বাচন ছিল। এ সময় তাকে থামিয়ে বিচারক বলেন, প্রত্যেক জেলায় নির্বাচনি ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়। যেখানে যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন দায়িত্বে থাকেন। আগে যার ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা সেটা আপনি ৫ লাখে উন্নীত করেছেন। এতে কি জনগণের টাকা অপচয় হয়নি? এ বিষয়ে তার জানা নেই জানিয়ে বলেন, পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করে হয়ত ভাতা বাড়ানো হয়েছিল।
এরপর বিচারক আবারো বলেন, এই যে ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়েছিল নির্বাচনের সময় কোথাও কী তারা সরেজমিনে গিয়েছিলেন? তখন আউয়াল বলেন, একজন রিটার্নিং অফিসারের অধীনে ৪-৫টা সংসদীয় আসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে সহযোগিতা করতে আরো ৪-৫ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার থাকেন। একটা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ২ ভাগ দায়িত্ব কমিশনের বাকি ৯৮ ভাগ দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে কাজ করা অফিসারদের।
নির্বাচনের আগে এমন অবস্থা জেনে আপনি পদত্যাগ করলেন না কেন? বিচারকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই অবস্থায় পদত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। আমার এক বন্ধুও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল পদত্যাগের কথা, আমি বলেছি তুমি যদি আগে বলতা এমন ভয়ংকর নির্বাচন হবে তাহলে আমি দায়িত্বই নিতাম না।
কেকে/ এমএস