দেশের নিরীক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে কয়েক লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে এবং ঋণ খেলাপি সহজ হয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হ্রাস পেয়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও সুশাসনের অভাব এখন দেশের আর্থিক খাতের একটি সাধারণ বাস্তবতা, যার অন্যতম কারণ হলো নিরীক্ষা ইকোসিস্টেমের গুণগত দুর্বলতা এবং পেশাদার হিসাববিদদের সংকট।
গতকাল মঙ্গলবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অডিটরিয়ামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) এর সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ এফসিএমএ এসব কথা বলেন।
আইসিএমএবি সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ফলে দেশে নিরীক্ষা ইকোসিস্টেম কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর প্রত্যক্ষ বিরূপ প্রভাব পড়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে। তিনি জানান, বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক খাতসহ পুরো ব্যবস্থায় দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি প্রায় ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যাংক সম্পদ পাচারের অভিযোগও এই দুর্বল নিরীক্ষা কাঠামোর ফাঁকফোকরেরই ফল। একইভাবে, অস্থির ও অনিশ্চিত শেয়ারবাজারে প্রচলিত দুর্বল শাসনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।
তিনি বলেন, নিম্নমানের নিরীক্ষা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করেছে, যার ফলে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে (বাংলাদেশে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে ভিয়েতনামে তা ৩৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে খেলাপী ঋণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ। পর্যাপ্ত তদারকির অভাব, দুর্বল আইন প্রয়োগ, এবং সীমিত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, যেখানে তদারকির ব্যর্থতাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে, বৈশ্বিক সেরা অনুশীলনের উদাহরণ, দাতা সংস্থাগুলোর (বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক) পরামর্শ এবং অন্যান্য অংশীজনের মতামত বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালে ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। সেই সময়ে, এই সংস্কার কার্যকর করার ক্ষেত্রে আইসিএমএবি কার্যকরী অংশীদার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ৫ জন, যেখানে ভারতে রয়েছে ৩,৭৫,০০০ জন, পাকিস্তানে ১০ হাজার ৯৬ জন, শ্রীলঙ্কায় ৭ হাজার জন এবং নেপালে ৯ হাজার ৫২ জন যা আঞ্চলিক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পেশাদার হিসাববিদদের ঘাটতির প্রমাণ দেয়। ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)-এ কাউন্সিল (এফআরসি)-এ নিবন্ধিত ফার্মের সংখ্যা মাত্র ২০৯টি, এবং আইসিএবি-এর প্রায় ৫০০ জন প্র্যাকটিসিং সদস্য রয়েছেন, যাদের ওপর নিবন্ধিত ৩ লাখেরও বেশি কোম্পানির নিরীক্ষার দায়িত্ব রয়েছে (সক্রিয় কোম্পানির সংখ্যা কম হতে পারে)। এটি বাংলাদেশের নিরীক্ষা পরিবেশের বর্তমান বাস্তব চিত্র স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
আইসিএমএবি’র প্রেসিডেন্ট বলেন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশে একাধিক পেশাদার সংস্থাকে স্ট্যাটুটরি বা বিধিবদ্ধ নিরীক্ষার অধিকার প্রদান করা হয়েছে, যাতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রোধ করা যায়। কানাডায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএ), সার্টিফায়েড জেনারেল অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিজিএ) এবং সার্টিফাইড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএমএ) এই তিনটি পেশাদার সংস্থাকে একত্র করে সিপিএ গঠন করার উদাহরণও রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি সফল সমন্বয় ও সহযোগিতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, নির্দিষ্ট শর্তাবলীর আওতায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ছাড়াও একাধিক পেশাদার সংস্থা স্ট্যাটুটরি বা বিধিবদ্ধ নিরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে। সিএবি-এর পাশাপাশি। সিএমএ ছাড়া আর কোনো হিসাববিদ প্রতিষ্ঠান নেই।
তিনি বলেন, নিরীক্ষা জগতে একটি বাস্তবতা আজ সুস্পষ্ট দেশে বছরে প্রায় ৩ লাখ নিবন্ধিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং আরো অনেক বেশি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। মাত্র ৫০০ জন প্র্যাক্টিসিং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং ২০৯টি ফার্ম দিয়ে তা কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা একেবারেই অবাস্তব। কারণ, এই ফার্মগুলো শুধু নিরীক্ষা নয়, বরং ট্যাক্স ও ভ্যাট পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবাও দিয়ে থাকে। এত অল্প সংখ্যক ফার্মের মাধ্যমে জাতীয় প্রয়োজনে পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারা এক প্রকার অসম্ভব। উপরন্তু, নিরীক্ষা একটি বিশেষায়িত সেবা, যেখানে পরিমাণের চেয়ে গুণমানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
মাহতাব উদ্দিন বলেন, দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূরীকরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার কর্তৃক ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এফআরসি কর্তৃক সংজ্ঞায়িত চৎড়ভবংংরড়হধষ অপপড়ঁহঃধহঃ (ঈঅ ও ঈগঅ) দ্বারা লিমিটেড কোম্পানি ব্যতীত সব প্রতিষ্ঠান (ঝগঊ) সহ নিরীক্ষা করানোর বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় অর্থবিল হতে সিএমএদের বাদ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে এবং আর্থিক সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সিএমএদের সুযোগ দিয়ে সে বিধানটি পুনরায় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে গেলে নিরীক্ষা ইকোসিসটেম-এ আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এই সংস্কারের কথা চিন্তা করেই এফআরসি অ্যাক্ট-২০১৫, সিএ এবং সিএমএ-দেরকে প্রফেশনাল হিসাববিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমাদের দাবি, এই স্বীকৃতি অন্য সব আইনে সন্নিবেশিত করা হোক, যেটা কোম্পানিজ অ্যাক্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য এফআরসি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সেলিম এফসিএমএ, সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. দেলোয়ার হোসেন এফসিএমএ, ভাইস-প্রেসিডেন্ট মো. কাউসার আলম এফসিএমএ, সেক্রেটারি হাসনাইন তৌফিক আহমেদ এফসিএমএ, কাউন্সিল সদস্য মো. আখতারুজ্জামান এফসিএমএ এবং কাউন্সিল সদস্য মো. জাহাঙ্গীর আলম এফসিএমএ।
কেকে/এআর