অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত শুক্রবার লন্ডনে বৈঠক করেন। এ বৈঠকের পরই দেশের রাজনীতিতে ফের নির্বাচনি আলোচনা তুঙ্গে। নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাস ধরে আলোচনার টেবিলে ঝড় তোলা হচ্ছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি কোন দল কীভাবে নিচ্ছে, ভোটের মাঠ নিয়ন্ত্রণে নানা কৌশল নিয়েও এখনো জনগণের মধ্যে জোরালো আলোচনা আছে।
তবে গত ৫ আগস্ট হাসিনার সরকারের পতনের পর রাজনীতির ময়দানে পুনরায় শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া দল বিএনপির অভ্যন্তরে ক্রমেই বাড়ছে কোন্দল ও সহিংসতা। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূলে বাড়তে থাকা সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দলটির নেতারাও। ফলে নির্বাচনের আগে দলটির সামনে অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সহিংসতা। যদিও দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভাষ্য, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দলটির পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ফলে আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেকটা কমে এসেছে।
কিন্তু মাঠের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এরই মধ্যে সারা দেশে বিভিন্ন জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের উল্লেখসংখ্যক নেতাকর্মী। বিশেষ করে চট্টগ্রামেই বিভিন্ন সংঘর্ষে প্রাণ গেছে ১৩ জনের। মাঠ দখল, ব্যানার টাঙানো, মেলা আয়োজন, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, এমনকি শুভেচ্ছা জানানো নিয়েও ঘটেছে রক্তাক্ত সংঘাত। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও, বায়েজিদ, কুসুমবাগ, মিরসরাই, বারইয়ারহাট, দাঁতমারা, ছলিমপুর, বাড়বকুণ্ড, সন্দ্বীপ, রাউজানসহ নানা এলাকায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বেই ঘটেছে এসব হত্যাকাণ্ড। প্রায় সব ক্ষেত্রেই গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে আসছে আসামিরা, অনেক সময় মামলাও পড়ে থাকছে অগ্রগতিহীন।
এ ছাড়া কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে সাবেক এমপি গফুর ভূঁইয়া ও মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার অনুসারীদের দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন সেলিম উদ্দিন ভূঁইয়া। বগুড়ায় গোকুল ইউনিয়নে মিজান ও বিপুল গ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। কিশোরগঞ্জে বিএনপির উপজেলা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন আবুল হাসান রতন এবং ছাত্রদল নেতা আশিক খাঁ। একইভাবে মাদারীপুর, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, ঝিনাইদহ, রংপুর, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভোলা, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তার এবং কমিটি নিয়ে বিরোধের জেরে বিএনপির ভেতরে সহিংসতা রক্তাক্ত রূপ নিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যখন বড় সুযোগের মুখোমুখি। এমন সময় তৃণমূলের দ্বন্দ্ব দলটির ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি এখনই তৃণমূলে দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে নির্বাচনের আগেই দলের ঐক্য ও সুশৃঙ্খল কাঠামো নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। এমন বাস্তবতায় নির্বাচনের আগে দলটির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খোলা কাগজকে বলেন, ‘আসলে নির্বাচনে যারা প্রার্থী হন তাদের জনগণের কাছে সুপরিচিত থাকতে হয়। স্থানীয় মানুষের সমর্থন, পছন্দ-অপছন্দের বিষয় রয়েছে। মানুষের কাছে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হয়। ইদানীংকালে দেখা গেছে লুটেরা অর্থনীতির কারণে কিছু কিছু সুবিধাবাদী মানুষ দলের মধ্যে ঢুকে পড়ে; আর অঘটনটা তারাই ঘটাচ্ছে। ত্যাগী নেতাদের রাজনীতি করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দলকে অবশ্যই এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সুযোগ সন্ধানীরা দলের মধ্যে ঢুকে ভয়ংকর যে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। দলকে অবশ্যই সর্তক থাকতে হবে। যদিও দল থেকে সব সময় মনিটং করা হয়। নির্বাচন সামনে এখন আরো বেশি সর্তক হয়ে চলতে হবে। স্থানীয় রাজনীতির প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খোলা কাগজকে বলেন, ‘সব ঘটনায় যে বিএনপি জড়িত এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে না এটাও বলা ঠিক হবে না।’ তিনি বলেন, ‘কিছু সুযোগসন্ধানী লোক আছে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপির কাছাকাছি থেকে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। স্বার্থের দ্বন্দ্বেই বিরোধ তৈরি হয় যার পরিণতি ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপির নামধারী যারা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, পদ স্থগিত করা হয়েছে, শোকজ করা হচ্ছে এবং কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত।’
এর আগে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে না, সেটা আমরা বলবো না। কিন্তু দেখতে হবে এটাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে কিনা। মোটেই তা হচ্ছে না। জড়িতদের বহিষ্কার করা হয়েছে, পদ স্থগিত করা হয়েছে, শোকজ করা হচ্ছে এবং সেখানে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলেÑ কেউ এখান থেকে বাদ যাচ্ছে না।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৭ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত ১০ মাসে বিএনপি নেতাকর্মীদের হাতে ১২৩ জন খুন হয়েছেনÑ এমন অভিযোগ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কয়েকজন নেতা। তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ অভিযোগের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
গত মঙ্গলবার সকালে মির্জা ফখরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে ওই সময়কালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হত্যাকাণ্ডের খবরের বিশ্লেষণ তুলে ধরেন, যা যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা বাংলা আউটলুকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, গত ১০ মাসে ১২৩ হত্যাকাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অন্তত ২১টি ঘটনায় বিতর্কিতভাবে বিএনপির নাম এসেছে। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের খবরগুলোতে দেখা গেছে, দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আধিপত্য বিস্তার, লেনদেন সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ও এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বের কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা সরাসরি রাজনৈতিক স্বার্থে বা দলীয় কারণে খুন করেছেন এমন তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়নি; শুধু রাজনৈতিক পরিচয় উঠে এসেছে।
কেকে/এএস