ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পলায়নের পর দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রথম থেকেই নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এসব দাবি-দাওয়া আর আন্দোলনের চাপে ব্যাহত হতে থাকে স্বাভাবিক কাজকর্ম, দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ।
এসব আন্দোলনের সিংহভাগ হতে থাকে দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়মুখী। একসময় প্রশাসনের কঠোরতায় সচিবালয়মুখী এই আন্দোলনগুলো নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে নতুন করে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সচিবালয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ কেন্দ্র করে সচিবালয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা জাতীয় স্বার্থে এক গভীর উদ্বেগের বিষয়। দেশ যখন একটি সংকটময় ও সংবেদনশীল সময় অতিক্রম করছে, তখন রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়া একটি অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এই অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে স্বৈরাচারী শক্তির উত্থানের সুযোগ করে দিতে পারে।
সরকারি কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে বেতন বৈষম্য নিরসনের জন্য ১০ ধাপে বেতন নির্ধারণ ও অবিলম্বে নবম বেতন কমিশন গঠনের জোর দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, শতভাগ পেনশন সুবিধা এবং ৫০০ টাকা হারে গ্রাচ্যুইটি নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সচিবালয়ের মতো সব দপ্তরে অভিন্ন নিয়োগবিধি, সমকাজে সমবেতন ও পদবি পরিবর্তনের দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা, ২০ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, ন্যায্যমূল্যে রেশন সরবরাহ, আউটসোর্সিং নিয়োগ বাতিল এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-এর ৮৭ ও ৯৮ নম্বর কনভেনশনের আলোকে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার প্রদান।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে সরকার সম্প্রতি ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে, যা সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছাড়াই চাকরি থেকে বরখাস্তের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই অধ্যাদেশকে কর্মচারীরা ‘নিবর্তনমূলক’ ও ‘কালাকানুন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের আশঙ্কা, এর ফলে যে কোনো দমনমূলক সিদ্ধান্ত বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে বাধ্য হবেন তারা এবং এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
এ অধ্যাদেশের প্রতিবাদে সোমবার সচিবালয়সহ বিভিন্ন স্থানে দিনভর বিক্ষোভ হয়েছে এবং আন্দোলনকারী কর্মচারীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবারও কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তাদের জানান, অবিলম্বে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সচিবদের পদত্যাগ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের পদত্যাগ ও গ্রেপ্তার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছে, যার মধ্যে এই ‘কালো আইন’ বাতিল অন্যতম। পরিষদের মহাসচিব বদরুল আলম সবুজ বলেন, ‘বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে চাকরিচ্যুতির বিধান রেখে কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, ‘এই কালো অধ্যাদেশ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও পরিষদের আরেকাংশের সভাপতি মুহা. নূরুল ইসলাম জানান, ‘সারা দেশের কর্মচারীরা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।’
এদিকে সরকার সম্প্রতি একটি রিফর্ম প্যাকেজের অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে এনবিআরের কর্মচারীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং কর্মবিরতি পালন করে। শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ মঙ্গলবার থেকে দুই দিনের কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করবে। সাময়িক বরখাস্ত, বিভাগীয় মামলা, পদোন্নতিতে কোটা ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের প্রতিবাদে এ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিটি সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে, তবে জরুরি সেবা এর বাইরে থাকবে। পরিষদ অভিযোগ করেছে, সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখির কারণে ১২ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হলেও প্রশাসন ক্যাডারের অনিয়মে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া, কোটা সংক্রান্ত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও আপত্তি জানিয়েছে পরিষদ।
এর আগে পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ২৫ ক্যাডারের সদস্যরা ২০ মে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। এ ছাড়া গত ২ মার্চ পূর্ণদিবস কর্মবিরতি এবং গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে ১ ঘণ্টার কলমবিরতি কর্মসূচি ও ২৬ ডিসেম্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা লাগাতার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেছেন। কনসালটেশন কমিটির সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে তিন দফা দাবি আদায়ে তারা এই আন্দোলন করছেন। দাবিগুলো হলো সহকারী শিক্ষক পদে ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেডে জটিলতা নিরসন এবং প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি নিশ্চিত করা। এর আগে তারা এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা ও অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন। শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন, ১২তম গ্রেডের প্রস্তাব অসম্মানজনক এবং তা তারা কখনোই মেনে নেবেন না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে, তবে কোনো পরীক্ষা কর্মসূচির আওতায় থাকবে না।
দেশের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টানা ষষ্ঠ দিনের মতো শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার পরও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এবার দাপ্তরিক কাজ থেকে পূর্ণ কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার থেকে দেশের সব পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অফিস কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হবে। সাত দফা দাবিতে এ কর্মসূচি চলছে, যার মধ্যে রয়েছে আরইবি চেয়ারম্যানের অপসারণ, চাকরিবিধি একীকরণ, অস্থায়ী কর্মীদের নিয়মিতকরণ, হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও বরখাস্ত কর্মীদের পুনর্বহাল, শাস্তিমূলক বদলি বাতিল, পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ ও অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন। আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, দাবিগুলো আদায় না হলে ভবিষ্যতে আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। তাদের দাবি, এটি বৈষম্যহীন বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার জন্য একটি যৌক্তিক আন্দোলন, যা আরইবি ভুলভাবে উপস্থাপন করছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবসময়ই নিজেদের অতি ক্ষমতায়িত ভাবে এবং সেই কারণে নিজেরা যেটাকে যৌক্তিক মনে করে সেটাকেই নিজেদের মতো করে তারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। সরকারি কর্মচারীরা জানেন তাদের কোন ধরনের আচরণ করা যাবে না। তাদের অযাচিত অবস্থানের পাশাপাশি সরকারের কোনো উদ্যোগ না থাকায় অচলাবস্থার তৈরি হয় এবং তাতে করে জনভোগান্তি তৈরি হয়। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করছেন, এ অধ্যাদেশটি এখন প্রয়োজন ছিল না। কারণ অধ্যাদেশে যেসব বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো অন্য বিদ্যমান আইনগুলোতে আছে। কর্মচারীরা এখন বলপ্রয়োগ করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি সরকার কেন সবার সাথে আলোচনা না করে তড়িঘড়ি করে এ ধরনের একটি অধ্যাদেশ করলো সেই জবাবটাও সরকারকে দিতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘সরকারকে জিম্মি করার চেষ্টা করা হলে তার পরিণাম ভালো হবে না। জনগণ এসব কর্মকর্তাদের বিকল্প খুঁজে নেবে।’
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘এখন সচিবালয়েও দেখছি আন্দোলন হচ্ছে, বিক্ষোভ হচ্ছে। এনবিআর সংস্কারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যখন ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান চলছিল, তখন আপনারা শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে কালো ব্যাজ ধারণ করে অফিস করেছেন। এখন আপনারা হুমকি দেন, অফিস চলতে দেবেন না, অফিস বন্ধ করে রাখবেন।’
এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে যদি আপনারা জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সরকারকে হুমকি-ধমকি দেন, সংস্কার কার্যক্রমে বাধা দেন, তাহলে মনে রাখবেন- জনগণ আপনাদের বিকল্প খুঁজে নেবে। ৫ আগস্ট পর্যন্ত কোনো সচিব, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কি পদত্যাগ করেছিলেন? রাস্তায় সাধারণ নাগরিকদের সন্তানদের গুলি করে মারা হচ্ছিল, তখন একজন আমলা বা কর্মকর্তার পদত্যাগের খবর কি এসেছিল? আজ যখন সরকার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে, তখন আপনারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। যেখানে সহযোগিতা করার দরকার ছিল, সেখানে আপনারা প্রতিকূলতা সৃষ্টি করছেন।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হান্নান মাসউদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজ সচিবালয়, এনবিআর কিংবা পোর্টে যাঁরা স্ট্রাইক করছেন, তাঁদের বলছি, বিপ্লব ওখানেও হবে। আপনারা দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বাধীনতা চাচ্ছেন, কিন্তু চব্বিশ-পরবর্তীসময়ে এটা আর পাবেন না। হাসিনার পুরো শাসনামলের প্রতিটি গুম, খুন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার সবকিছুর সহযোগী আপনারা। ভাববেন না, পার পেয়ে গেছেন। পুনশ্চ বলছি, পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব দুর্নীতিগ্রস্তদের অপসারণ করে, নিরপেক্ষ কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।’
ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘সচিবালয় হলো রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র। সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ নিয়ে সচিবালয়ে যে ধরনের অবরোধ ও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা দেশের জন্য অশনি সংকেত। বাংলাদেশ যখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যখন দেশ একটি সামগ্রিক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন সচিবালয়ে এই ধরনের অচলাবস্থা পতিত স্বৈরাচারকে সুযোগ করে দেবে। সচিবালয় ও সারা দেশের সরকারি অফিস অচল করার কর্মসূচি থেকে সরে এসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করতে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা-যোগ্যতা ও জবাবদিহিতা রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ফলাফলমুখী চরিত্র ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচির মতো করে সচিবালয় অবরুদ্ধ করা, কোনো আইনসিদ্ধ পন্থা হতে পারে না।’
কেকে/ এমএস