শেখ হাসিনার চরম দাম্ভিকতা ও ক্ষমতালোভী স্বৈরশাসনের কারণে আওয়ামী লীগ ধ্বংসের মুখে। তার কর্মের কারণে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগকেও পলাতক দলে পরিণত করেন। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও তিনি ক্ষান্ত হননি। দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে তার নতুন কৌশল সবার সামনে এসেছে। যেখানে ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে দলকে আবার মাঠে নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এই কৌশল এখন তৃণমূল নেতাকর্মীদের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উসকানির ফাঁদে পড়েছেন এসব নেতাকর্মী। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়েছে এবং হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতারও হয়েছেন। অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
পতনের পর কিছু দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত ছিল পতিত আওয়ামী লীগ। দলের কর্মকাণ্ড পালন করা থেকে বিরত থাকলেও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার আন্দোলন সংগ্রামের ওপর ভর করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলা, এমনকি দিল্লিতে বসে সরকারকে উৎখাত করার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা-বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় বিচারের নামে প্রহসন বন্ধের’ দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পরে বিভিন্ন ফুটেজ দেখে ঝটিকা মিছিলে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে যুবলীগের ঝটিকা মিছিলে অংশ নেওয়া তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার ভোরে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত মঙ্গলবার সকাল ছয়টার দিকে শহরের হোটেল-মোটেল জোনের কলাতলী সৈকত সড়কে ঝটিকা মিছিল করে জেলা যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ভিডিওতে দেখা গেছে, ২০ থেকে ২৫ জনের মিছিলের সামনে একটি ব্যানার। তাতে লেখা ‘শেখ হাসিনা আসবেই, বাংলদেশ (বানান ভুল) হাসবেই’; আয়োজনে বাংলাদেশ যুবলীগ-কক্সবাজার জেলা।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াস খান বলেন, গ্রেফতার তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় নাশকতার অভিযোগ, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করার মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার অপচেষ্টার অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের আরো চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে ইসমত আরা হ্যাপিকে গ্রেফতার করে ডিবি-ওয়ারী বিভাগের একটি টিম।
অন্যদিকে ডিবি-লালবাগ বিভাগের একটি দল রাত ১০টায় কোতোয়ালি এলাকা থেকে আজিম মাহবুব আলমকে গ্রেফতার করে। রাত ১১টায় কোতোয়ালি থানাধীন ইসলামপুর এলাকা থেকে সাইফুল ইসলাম সাগরকে গ্রেফতার করে ডিবি-সাইবার বিভাগের একটি টিম। একই দিন বিকেল ৫টায় ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগের একটি অভিযানিক দল রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন বসিলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তানজিম রহমান আকাশ দেওয়ানকে গ্রেফতার করে। ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করার মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
এর আগেও রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে শপথ নেন।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শেখ হাসিনা বরাবরই একরোখা ও জেদী মনোভাবের মানুষ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গত ৮ মাস বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার উসকানির ফাঁদে পড়ে এখন তৃণমূল আওয়ামী লীগও ঘরছাড়া হতে চলেছে। বেশি বিপদে রয়েছে দলটির ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অনেকেই হামলা মামলার শিকার হবেন, অনেকেই গ্রেফতার হবেন। একজন ব্যক্তির জন্য পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত এবং পর্যুদস্ত অবস্থায় দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করবেন।
এদিকে শেখ হাসিনার এমন সব কর্মকাণ্ডের কারণে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও তার প্রতি চরম ক্ষুব্ধ। যারা মনে করেছিলেন, সত্যিই শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসতে পারবেন। আওয়ামী লীগ এভাবে ঝটিকা মিছিলের মধ্য দিয়ে দ্রুত রাজনীতিতে ফিরতে পারবে, তাদের সে আশা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। তাই শেখ হাসিনা এবং পরিবারের সদস্যদের সুবিধার জন্য কেউ আর রাজপথে নামবে না। এ ছাড়া বিদেশে পলাতক থেকে দলের যেসব গডফাদার উসকানি দিচ্ছেন তাদেরও তারা ফাইন্যালি লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, শেখ হাসিনা বা তার দলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে যে কর্মসূচির আহ্বান আসছে, তা ভালো কী মন্দ, ঠিক না ভুল; সেটা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। তারা তাদের মতো রাজনীতি করবে এবং তারা সেটা করতে পারে। আমি সাধারণ নাগরিক হিসাবে মনে করি আওয়ামী লীগের যারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, তারা নিজেরাও জানে তারা প্রচুর অপরাধ করেছে। এর বিচার হলে তাদের সাজা ভোগ করতে হবে এটাও তারা জানে।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে নিজেদের পুনর্বাসিত করার জন্য অনেক কিছুই করবে। তারা কর্মসূচি দেবে, কর্মসূচির পেছনে টাকা ঢালবে। প্রয়োজনে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা এ ধরনের করাপট লিডারশিপের পেছনে থাকবে, নাকি নিজেরাই বিকল্প লিডারশিপ গড়ে তুলবে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ও মাঠে নামা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ-উর রহমান বলেন, আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ চাইছে, কোনো রাজনৈতিক দল তাদের থামাবে বা সরকার তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নেবে। এরপর আওয়ামী লীগ গ্লোবালি পেজেন্ট করবে যে তারা তো নিষিদ্ধ দল না। ফলে নিষিদ্ধ করার আগ পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের সাংবিধানিক অধিকার তাদের রয়েছে এটা দেখানোর জন্যই নেতারা বাইরে নিরাপদে বসে থেকে এগুলো করাচ্ছে।
এর মধ্য দিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের বিপদের মধ্যে ফেলা হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তো বটেই। যে কয়জন পালাতে পারেনি, তারাও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগেই শেখ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়রা দেশ ছাড়ে। যা রহস্যজনক। অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা এমন পরিস্থিতি আগেই জানতে পেরেছিলেন। এজন্য শেখ পরিবারের সবাইকে তিনি আগেই বিদেশে পার করে দেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। সেখানে তানভীর নামে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ফোনালাপে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন হাসিনা। এ ছাড়া খুব দ্রুত দেশের ফিরবেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমি দেশের খুব কাছাকাছি আছি। অতদূরে নাই। আমি খুব কাছাকাছিই আছি, যাতে আমি চট করে ঢুকে পড়তে পারি।’
গত এপ্রিলে একটি ভার্চুয়াল আলোচনা ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা ওই আলোচনাপর্বে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সমস্যার কথা শোনেন শেখ হাসিনা। সেদিন নেতাকর্মীদের তিনি বলেন, ‘এক গালে চড় মারলে আরেক গাল পেতে দেওয়ার সময় শেষ। যারা আমাদের ওপর আঘাত করেছে, তাদের জবাব দিতে হবে, শিক্ষা দিতে হবে। কবে সময় আসবে সেটার জন্য অপেক্ষা করলে হবে না, এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে।’
এ মাসেই আরেকটি বক্তব্যে তিনি নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘যে যেখানে আছ, তুমিই সেখানকার নেতা। কারো নির্দেশের অপেক্ষায় থাকার দরকার নাই।’ এর আগে তার বক্তব্যের জের ধরে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে ভাঙচুর শুরু হয়। ওই সময় ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের পাশাপাশি সুধাসদনসহ ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগের আরো অনেক নেতার বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, শেখ হাসিনার বক্তব্যে সাধারণ নেতাকর্মীরা অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে মাঠে নামেন। মিছিল করে তার ছবি এবং ভিডিও পাঠায় হাইকমান্ডের কাছে। সেগুলো আওয়ামী লীগ তাদের দলের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে আপলোড দেওয়া হয়। এভাবে তারা দলের নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
এ ছাড়া ঢাকার বাইরেও বেশ কিছু ঝটিকা মিছিল বের করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন। এপ্রিল মাসেও চট্টগ্রামে মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া খুলনা, রাজশাহী, সিলেটসহ আরো বিভিন্ন স্থানে রাতে ও ভোরবেলা ঝটিকা মিছিল করে দলটির নেতাকর্মীরা। তবে সারা দেশে গ্রেফতার অভিযান শুরু হওয়ার পর ঝটিকা মিছিল তো দূরের কথা তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
কেকে/ এমএস