ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলের সিটে থাকাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ওয়াসিফ আল আবরারকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এসময় তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে সাংবাদিক, সহসমন্বয়ক সহ অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) দিবাগত রাত আনুমানিক পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আজিজুর রহমান হলের দেশীয় ব্লকের ৪০৫ নং কক্ষে এই ঘটনা ঘটে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শাহ আজিজুর রহমান হলের ৪০৫ নম্বর কক্ষে অতিথি হিসেবে অবস্থান করছিলেন সাংবাদিক আবরার। এ সময় কয়েকজন শিবিরের কর্মী তার কক্ষে গিয়ে সে কেন ওই কক্ষে অবস্থান করছে তা জানতে চায়। কথাবার্তার একপর্যায়ে আবরার ছাত্রলীগ করে এমন অভিযোগ তুলে তাকে হল থেকে নেমে যেতে বলে তারা। সাংবাদিকের সাথে দুর্ব্যবহারের সময় আবরার তার ফোনে তাদের ভিডিও ধারণ করে। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ভিডিও চলাকালেই তারা রুমে ঢুকে লাইট বন্ধ করে ফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং মারধর করে।
এসময় আবরারের রুমমেট ইমন এসে তাদের থামিয়ে দিয়ে আবরারকে সময় দেওয়ার অনুরোধ জানালে তারা ২ মিনিটে সব জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এসময় তারা আবরারের ফোনের ভিডিও ডিলেট করতে বারবার চাপ দেয়। সে ভিডিও ডিলেট করতে সম্মত না হলে আবারো তার উপর চড়াও হয়। এসময় তাকে টেনেহিঁচড়ে রুমের বাইরে বের করলে বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার সাবেক সেক্রেটারি সাজ্জাতুল্লাহ শেখ এসে তাদের হাত থেকে আবরারকে বাঁচানোর চেষ্টা করে এবং কোন অভিযোগ থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের না বললে সাজ্জাতুল্লাহর সাথেও বাকবিতণ্ডায় জড়ায় শিবিরকর্মীরা।
এসময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক নাহিদ হাসান, ইয়াশিরুল কবীর, তানভীর মন্ডল, মুবাশ্বির আমিন, শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আনোয়ার পারভেজ, তার অনুসারী তৌহিদ, অর্ক, আলামিন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ইসমাইল হোসেন রাহাত, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহমুদুল হাসান ছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও হলের শিক্ষার্থীরা৷
এসময় আবরারকে ঘিরে টানাহেঁচড়া করে কয়েকজন। শাখা শিবিরের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক মোজাহিদ, ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক জাকারিয়া আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০-২১ শিক্ষাবর্ষের নাহিদ, আমির ফয়সাল, ২১-২২ সেশনের নাহিদ, সহ-সমন্বয়ক তানভীর মন্ডল, মুবাশ্বিরের সাথে অপর সহ সমন্বয়ক নাহিদ, ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি রাহাত, সাজ্জাতুল্লাহ শেখ ও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ধস্তাধস্তি হয়। টিশার্ট ধরে টানাটানির একপর্যায়ে ভুক্তভোগী আবরার গলায় আঘাত পান এবং মাথার পেছনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কিছুক্ষণ পরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাকে ধরাধরি করে নিচে নামিয়ে ছাত্রদলের কর্মী রোকনুজ্জামান অর্ক এবং তালাবায়ে আরাবিয়ার সাবেক সেক্রেটারি সাজ্জাতুল্লাহ ইবি মেডিকেলে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা চলাকালীন বাইরে আবারও মারামারিতে জড়ায় দুই গ্রুপের শিক্ষার্থীরা। এসময় সহসমন্বয়ক নাহিদ, সায়েম, রাহাত, তৌহিদ, রাকিবসহ উভয় গ্রুপের বেশ কয়েকজন আহত হয়। পরবর্তীতে মিছিল নিয়ে ভিসি বাংলোর সামনে গেলে সেখানে আরেক দফায় বাকবিতন্ডায় জড়ায় দুই গ্রুপের সদস্যরা৷ পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন এবং ভিসির সাথে কথা বলতে বাংলোতে প্রবেশ করে। ঘটনা ঘটার ঘন্টাখানেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান এবং ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম ক্যাম্পাসে আসেন এবং প্রক্টর অফিসে উভয় পক্ষের সাথে মিটিংয়ের ডাক দেন।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক আবরার বলেন, আমি শহীদ জিয়াউর রহমান হলের বৈধ সিটধারী হলেও নানা অজুহাতে আমাকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি। বিষয়টি আমি রোজার মধ্যে জিয়া হলের প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টর এবং ভিসি স্যারকে জানালেও দেড় মাসে তারা কোন পদক্ষেপ নেননি। আবাসন সংকটে বাধ্য হয়ে আমি শাহ আজিজ হলের ৪০৫ নং রুমে কাছের বড় ভাই বাড়িতে থাকায় তার বেডে অবস্থান করছিলাম। গভীররাতে আচমকা কয়েকজন দরজা নক করতে থাকে এবং পরবর্তীতে আমাকে মারধর করে। আমি তখনি হল থেকে চলে যেতে চাইলেও নাহিদ ভাইরা আসায় তারা আবারো আমার উপর চড়াও হয়। চতুর্দিকের টানাহেঁচড়ায় আমার গলায় ফাস লেগে দম আটকে যায়।
এর আগেও তাকে ছাত্রলীগের দোসর ট্যাগ দিয়ে হুমকি দেওয়া হতো উল্লেখ করে বলেন, রমজান মাসে ছাত্রশিবিরের জাকারিয়া আমাকে দু'দফায় ফোন দিয়ে থ্রেট দেয়। নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় আমি বিষয়টি প্রক্টর ও ভিসিকে লিখিত ভাবে জানালেও এতদিনেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি। আমাকে বলা হয় ছাত্রলীগের দোসর অথচ জুলাই অভ্যুত্থানে আমার ভূমিকা কেমন ছিল, ২ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের কাভার করা নিউজের স্ক্রিনশট প্রিন্ট করে প্রক্টর, ভিসি সবাইকে দিয়েছি। ক্যাম্পাসে এখনো পোস্টেড ছাত্রলীগের সহসভাপতিরা ঘুরে বেড়ায় অথচ ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে।
সহসমন্বয়ক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, শিবির এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অংশ রাতের বেলায় হঠাৎ করে মব সৃষ্টি করে আবরারের ওপর হামলা চালায়। পরে যখন আমরা তাদের কল পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাই, তখন তারা আমাদের ওপরও হামলা করে। হামলার কারণ হিসেবে তারা জানায় যে, ‘জুলাই আন্দোলনে’ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিউজ লিখেছেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত কোনো ঝামেলার কারণে হামলা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে আমার জানা নেই।
ইবির বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহসমন্বয়ক নাহিদ হাসান বলেন, ‘আবরারকে নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয় তখনি আমি ওর সমস্ত ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছি। আন্দোলনের সময় ও কি কি নিউজ করেছে তা আমি দেখেছি। সে এর আগেই ভিসি স্যারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবেন। আমি জানি না তারা সবসময় মবের অপেক্ষায় থাকে কিনা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘গতকালের ঘটনাটি আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। আমি যতটুকু জানি একটা সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে এই ঘটনাটি ঘটেছে। তারপরও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই এর একটি সুষ্ট তদন্ত করতে। তদন্তে যারাই দোষী তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
শাহ আজিজুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এটিএম মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা জানতে পেরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। খুব শীঘ্রই তাদের প্রতিবেদন পাওয়া যাবে এবং প্রতিবেদন পাওয়ার পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড শাহিনুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল। গতকাল রাতে প্রক্টরিয়াল বডির সাথে মিটিংয়ে তারা নিজেদের মধ্যে মিমাংসা করার আশ্বাস দেয়। আবরারের নিরাপত্তা এবং ঘটনার সার্বিক বিষয়ে একটি হল প্রশাসন এবং আরেকটি ইবি প্রশাসন থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কেকে/ এমএস