গত বছরের পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের কয়েক ডজন নেতা বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হন। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যা মামলায় বিচার চলছে তাদের। এসব নেতারা শুরু দিকে চুপচাপ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদালতে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন তারা। এমনকি আদালতে আনা-নেওয়ার পথে সাংবাদিকদের কাছে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন কেউ কেউ। আইনজীবীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপিরা বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে আদালতে হাজিরা দিতে এসে নিজেদের এখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা বলে জাহির করার চেষ্টা করছেন।
একজন আইনজীবী বলেন, তারা বাড়তি সুযোগ-সুবিধারও আবদার করছেন। তবে তারা ভুলে গেছেন যে, অতীতেও অন্য দলের নেতাদের গ্রেফতারের পর কীভাবে আদালতে হাজির করা হতো!
‘তোদের চৌদ্দ গোষ্ঠী খেয়ে ফেলব’ আদালতে নেওয়ার সময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে হাসানুল হক ইনু-শাজাহান খানের এমন হুমকি কয়েক দিন ধরে জনসাধারণের মুখে মুখে। নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছে দুই আসামির এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও শাজাহান খানের হেলমেট ছুড়ে ফেলার দৃশ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা এ নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ সাবেক এই দুই মন্ত্রীর আচরণ ভয়ঙ্কর হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গতকাল বুধবার আদালতে শেখ হাসিনার আগে জামায়াত, জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার বিচার করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এদিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলায় অন্য আসামিদের সঙ্গে তাকে আদালতে তোলা হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। এসময় শাজাহান খান হাত তুলে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, মামলা যদি দিতেই হয় তাহলে এসব গায়েবি মামলা না দিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
এজলাস থেকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার পথে শাজাহান খান আবারও বলেন, শেখ হাসিনার যে অভিযোগের বিচার হচ্ছে, সেই অভিযোগের চেয়ে একাত্তরের অভিযোগ গুরুতর। লাখ লাখ মানুষকে হত্যায় জামায়াত জড়িত। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ তিন হাজার সেনা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। এরশাদ সাহেবও হত্যা চালিয়েছে। তারাও গিলটি। তাদের বিচার আগে করে তারপর শেখ হাসিনার বিচার।
কয়েকজন আইনজীবী জানান, ইনু ও শাজাহান খান আদালতে আসার সময় পুলিশের সঙ্গে যে অভদ্র ও মাস্তানি করেছেন এমন আচরণ অতীতে কেউ করেননি। এর আগে গুমের হোতা জিয়াউল আহসানও এমন সন্ত্রাসী আচরণ পুলিশের সঙ্গে করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুল স্বীকার করে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালানোর জন্য ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়া উচিত। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখনো ক্ষমা চায়নি এবং চাইবে বলেও মনে হচ্ছে না। বরং তাদের ঔদ্ধত্য দিন দিন বাড়ছে। তারা বলছেন, যত দিন গড়াচ্ছে, আওয়ামী লীগ সক্রিয়া হওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছে। তার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময় ছটিকা মিছিল করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া ভারতে বসে দলীয় নেতা শেখা হাসিনা বিভিন্ন সময় উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। পলাতক অন্য নেতারাও দেশে থাকা দলীয় নেতাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখছেন। সব মিলিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে পতিত শক্তি। এরই ধারাবাহিকতায় জেলে থাকা নেতাদের আচরণও ক্রমশ উগ্র হয়ে উঠছে।
এর আগে গণহত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করার সময় হ্যান্ডকাফ পরানো নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের বাগবিতণ্ডা হয়েছে। গত রোববার প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়ার সময় উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
বিচারকাজ শুরুর আগে শাহজাহান খান তার হাতে হ্যান্ডকাফ দেখিয়ে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি নিজেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। এটা আমার জন্য অমর্যাদাকর। ’
তার আইনজীবীও আদালতের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিষয়টি জানতে পুলিশ সদস্যদের তলব করেন।
পরে পুলিশ সদস্য নুরুন্নবী ট্রাইব্যুনালকে জানান, পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী আসামিদের এভাবে হাজির করা হয়। আরেক পুলিশ সদস্য শহীদুল অভিযোগ করেন, প্রিজন ভ্যান থেকে নামানোর সময় আসামিরা তাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেন এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এই পুলিশ সদস্য অভিযোগ করে আর জানান, হাসানুল হক ইনু পুলিশ সদস্যদের ‘তোদের চৌদ্দ গোষ্ঠী খেয়ে ফেলব’ বলে হুমকি দেন এবং হাজতখানায় এসে মিটিং করে পুনরায় হুমকি দেন।
গত ৮ এপ্রিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আব্দুল জব্বার নামের এক শিক্ষার্থীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তাকে আদালতে উপস্থিত করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। এসময় শুনানিতে তুরিন আফরোজ বলেন, আমাকে ১০ দিন কেন ২০ দিনের রিমান্ড দিয়ে দিন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপির অনেকেই গ্রেফতার আছেন। তাদের বিরুদ্ধে করা বিভিন্ন মামলায় নিয়মিতই আদালতে নেওয়া হচ্ছে তাদের। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ১১ মন্ত্রীসহ ১৬ জনকে হাজির করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এদিন শুনানি শেষে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় এক গণমাধ্যমকর্মী সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে উদ্দেশ্য করে বলেন, পলক ভাই আজকে তো হরতাল। এর প্রতি জবাবে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘লড়াই করে বাঁচতে হবে, বঙ্গবন্ধু শিখিয়ে গেছে। আমরা লড়াই চালাচ্ছি। আইনগত লড়াইও চালাব। ন্যায়ের পথে লড়াই চলবে।’
গত মার্চ মাসে রাজধানীর লালবাগ থানায় করা হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সোলাইমান সেলিমকে। আদালতের এজলাসে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে সোলাইমান সেলিম বলেন, ‘অনেক সাংবাদিক ভুয়া নিউজ করেন। এসব ভুয়া নিউজ করে আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।’ এসময় কাঠগড়ার পাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে বারণ করেন। তখন সোলাইমান সেলিম পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘জবাই তো দেবেন, একটু সময় দেন।’ গত ৫ মার্চ আদালতে আনা হলে এসব কথা বলেন তিনি।
গত ৮ জানুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানার মো. আলী হত্যা মামলায় গ্রেফতার শুনানিতে আদালতের এজলাসে লিফটে না তুলে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করেন তিনি। আদালতের লিফটে না তুলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ৪ তলায় তোলা হয় তাদের। এ সময় আসামিদের নিরাপত্তাদানকারী পুলিশ সদস্যদের ওপর চটে যান কামরুল ইসলাম। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আদালতের লিফট কি নষ্ট?
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ফৌজদারি আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মেসবাহ জানান, অনেক সময় প্রসিকিউসনের দুর্বলতা এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রহসনের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, একজন নেতা সে যেই হোক তিনি মামলার আসামি। তাকে আদালতের নিয়ম মানতে হবে। কিন্তু পুলিশের ব্যর্থতার কারণে এসব আসামিরা আদালতে দম্ভোক্তি করার সুযোগ পাচ্ছেন।
কেকে/ এমএস