ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বৈরী হয়ে ওঠে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তার কিছুটা প্রশমিত হয়ে আসে। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর প্রত্যাশা করা হয়েছিল দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু সেই দিকে না গিয়ে ফের তিক্ততায় জড়িয়েছে প্রতিবেশী। এবার পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সংহিসতা নিয়ে বাকযুদ্ধে জড়িয়েছেন দুই দেশের কূটনৈতিকরা।
শুরুটা অবশ্য হয়েছে ভারদের দিক থেকে। দেশটির কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বিলের প্রতিবাদে আন্দেলনে নামে মুসলিম সম্প্রদায়। এ ঘটনাটিকে ঘিরে মুর্শিদাবাদ জেলায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। আর এ ঘটনার দায় সরাসরি বাংলাদেশিদের ওপর চাপিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ‘বাংলাদেশি দুষ্কৃতকারী’ জড়িত। একইসঙ্গে ওই সহিংসতার জন্য ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং বিজেপিকেও দায়ী করেছেন তিনি।
এদিকে মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়ানোর ভারতের চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যে কোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সরকার মুসলিমদের ওপর হামলা এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তাহানির ঘটনার নিন্দা জানায়। আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই।
ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ভিত্তিহীন অভিযোগের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, সরকার ভারতের এমন প্রচেষ্টাকে ‘তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান’ করেছে। তিনি বলেন, মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যে কোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি।
এদিকে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়ার পর তা নিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারতও। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, অনভিপ্রেত মন্তব্য না দিয়ে বাংলাদেশ বরং নিজেদের সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় মনোযোগ দিক। গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমের এক প্রশ্নের জবাবে জয়সোয়াল এ কথা বলেছেন। আজ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তার এ মন্তব্য তুলে ধরা হয়।
জয়সোয়াল বলেন, আমরা পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নিপীড়ন নিয়ে ভারতের উদ্বেগের সঙ্গে তুলনা টানার বিষয়টি প্রায় প্রকাশ্য ও কপট অপচেষ্টা। সংখ্যালঘু নির্যাতনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এখনো সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রণধীর জয়সোয়াল আরো বলেন, অনভিপ্রেত মন্তব্য না করে এবং নৈতিকতার আশ্রয় না নিয়ে বাংলাদেশ বরং নিজেদের সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় মনোযোগী হোক।
ভারতে মুসলিম ওয়াকফ সম্পত্তি কীভাবে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে, সেসব আইনকানুনের আমূল পরিবর্তন করে লোকসভায় একটি বিতর্কিত বিল পাস হয় গত ৩ এপ্রিল। পরদিন বিলটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অনুমোদন পায়। আইনের বিরুদ্ধে ভারতের নানা প্রান্তে তীব্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ দানা বাঁধে। গত সপ্তাহে মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলাকালে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হুগলি জেলায় এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আগুন লাগানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং রাস্তা অবরোধের ঘটনা ঘটে। ১২ এপ্রিল মুর্শিদাবাদে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া দেশটির উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরে জোর করে এক মুসলিম নারীর হিজাব খুলে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই নারীর সঙ্গে থাকা পুরুষকেও লাঞ্ছিত করা হয়ে। গত ১২ এপ্রিল এ ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যেগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে পুলিশ ৬ জনকে গ্রেফতার করে।
কেকে/ এএস