ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেএফসি এবং বাটা শো-রুমে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে অতিউৎসাহী কিছু বিক্ষোভকারী। যার বেশ কিছু ছবি-ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে দেখা গেছে- হামলাকারীরা কীভাবে বাটা শো-রুম থেকে জুতা-স্যান্ডেল লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ছিঃ ছিঃ রব উঠেছে দেশজুড়ে। সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন নেটিজেনরা। সবার একটাই প্রশ্ন- এ কেমন প্রতিবাদ?
রাজধানী ঢাকায় চলছে বিনিয়োগ সম্মেলন। যেখানে বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশের বিনিয়োগকারীরা অংশ নিয়েছেন। যারা কিনা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ঠিক এই সময়ে এমন একটা ঘটনা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, এই সম্মেলন থেকে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাহসিকতার কারণে দেশে এমন একটা সম্মেলন আয়োজন সম্ভব হয়েছে। যা বিগত সরকারের দীর্ঘ সময়ে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শক্তি যখন দেখছে এই সম্মেলন দেশের অর্থনীতির একটা টার্নিং পয়েন্ট, তখন এটাকে নস্যাৎ করার জন্য তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। পতিতরা তাদের নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠনের (ছাত্রলীগ) কর্মীদের ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে এসব হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে।
অবশ্য ঘটনার পরপরই ভিডিও ক্লিপ এবং স্থিরচিত্র দেখে দোষীদের গ্রেফতারের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৬ জনকে। এমনটাই জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ ইনভেস্ট সামিট ২০২৫-এর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলাকালে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শহরে দোকান ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত ৫৬ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করছে বিএনপি : দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা বলতে চাই, সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা এখানে লক্ষণীয়। তাদের উচিত ছিল আগে থেকেই এখানে সতর্কতা নিশ্চিত করা। তাহলে দেশের নামে এই বদনাম আমাদের হতো না।’
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেখানে তিনি এসব কথা বলেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বলে মন্তব্য করেন এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘তারা বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইসরায়েল ছাড়া সব দেশে গমনের যে নির্দেশনা ছিল, সেখান থেকে ইসরায়েল শব্দটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তার মানে তারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অথচ তারা বাংলাদেশের মুসলমানদের পক্ষে, সারা পৃথিবীর মুসলমানদের পক্ষে মায়াকান্নাও কাঁদত।’
সালাহ উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে মুসলিম বিশ্বের যারা মোড়ল, তাদের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা সারা পৃথিবীতে নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে আপনাদের কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করবেন এবং আপনারা ব্যবস্থা নেবেন, যাতে বিশ্বের বড় বড় শক্তিরা যারা ইসরায়েলের পক্ষে ভূমিকা রাখছে, সেটা বন্ধ হয়।’ অবিলম্বে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবি জানান বিএনপির এই নেতা।
হাসিনা সরকার আড়িপাতার যন্ত্র পেগাসাস, স্পাইওয়্যার ইসরায়েল থেকে খরিদ করেছিল বলেন সালাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আজকে হাসিনা যেখানে আশ্রয় নিক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ এই আওয়ামী ফ্যাসিবাদী ইসলামবিদ্বেষী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে যাবে।’
হেফাজত বলছে ঘটনার পিছনে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দোসররা : প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে হামলাকারীদের ‘আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দোসর’ বলে আখ্যা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এর নেপথ্যে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ইন্ধনের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে লুটপাটকারী ও হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে হেফাজত বলেছে, লুটপাটকারী ও হামলাকারীরা কোনোভাবেই তৌহিদী জনতার অংশ হতে পারে না।
গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান। বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচির সুযোগে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক (আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দোসর) দেশের কয়েকটি জায়গায় বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে। লুটপাটকারী ও হামলাকারীরা কোনোভাবেই তৌহিদী জনতার অংশ হতে পারেন না। যারাই হঠকারী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আলেম সমাজ ও তৌহিদী জনতাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করবেন, তাদের আলেমসমাজ প্রত্যাখ্যান করবে।
মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ছাড়া দখলদার অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলকে নির্মূল করা যাবে না বলে মনে করছে সংগঠনটি। বিবৃতিতে তারা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখলে নেওয়ার বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, এই বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের ২ নম্বর আর্টিকেল লঙ্ঘন করে। গাজা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। বিশ্বের কোনো স্বাধীন ভূখণ্ড দখল বা নিয়ন্ত্রণের অধিকার তার (ট্রাম্প) নেই। নেতানিয়াহুর দোসর হিসেবেই তিনি এমন বক্তব্য দিয়েছেন।
জামায়াতের প্রতিবাদ : ফিলিস্তিনের গাজা ও রাফায় ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সারা দেশে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সিলেট মহানগর জামায়াত। সোমবার রাতে একটি বিবৃতিতে দলের সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, নায়েবে আমির ড. নূরুল ইসলাম বাবুল এবং সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহজাহান আলী নিজেদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন।
তারা বলেন, ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েল কর্তৃক ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চলছে। এর প্রতিবাদে সিলেট নগরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, তৌহিদী জনতার ব্যানারে মিছিল বের করে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল দুর্বৃত্ত নগরীর বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ইসলাম শান্তির ধর্ম। কারো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলাকে ইসলাম সমর্থন করে না। ভাঙচুরকৃত সব প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা রয়েছে।
জাসদের নিন্দা : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিবাদ হচ্ছে, তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ)। একইসঙ্গে সোমবার দেশে বিক্ষোভের আড়ালে হওয়া লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে দলটি। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসন তথা ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন অভিযান সভ্যতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সক্রিয় সমর্থন, মদদ ও আশকারা পেয়ে ইতিহাসের এ জঘন্য গণহত্যা পরিচালনা করার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে ইসরায়েল। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমরা সে বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি।’
বিবৃতিতে বাংলাদেশ জাসদ নেতারা বলেন, ‘আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে বাংলাদেশে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আড়ালে একশ্রেণির দুষ্কৃতকারী সোমবার বিকেলে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে। এসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অরাজকতার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সংগত প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকে এ বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা কালিমালিপ্ত করেছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা সরকারকে এসব দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনা ও এ ধরনের নৈরাজ্যের পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতাকে এসব সুযোগ-সন্ধানীদের ফাঁদে পা না দিয়ে তাদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
এর আগে গতকাল দেশব্যাপী গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনবিরোধী বিক্ষোভের সময় সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, গাজীপুর ও বগুড়াসহ দেশের কয়েকটি শহরে বাটা শো-রুম ও কয়েকটি রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
সোমবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শহরে দোকান ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের জন্য জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম জানান, পুলিশের কাছে হামলাকারীদের ভিডিও ফুটেজ আছে। তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করা হবে। বাংলাদেশ পুলিশ বর্তমানে এ নিয়ে কাজ করছে। সরকার কোনো ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভে বাধা দেয় না। তবে, প্রতিবাদ কর্মসূচির আড়ালে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না।’
কেকে/এআর