প্রশ্নফাঁসের কৌশল রপ্তানি!
সাকির আহমদ
🕐 ২:১৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০১, ২০১৮
প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক ঢাকঢোল পিটিয়েছে। একের পর এক ঘোষণা এবং তর্জন-গর্জন করে মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নিলেও শেষ পর্যন্ত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় যা হয়েছে তাকে পর্বতের মূসিক প্রসব ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই পরিস্থিতিতে আজ থেকে সারা দেশে শুরু হয়েছে চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ হলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে-এমন ঘোষণাও দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। পরীক্ষা ১০টি বিষয়ে হয়েছে। সঙ্গে ছিল ঐচ্ছিক দুটি বিষয়। অর্থাৎ নজিরবিহীনভাবে ১২টি বিষয়েরই প্রশ্নফাঁস হয়েছে। শুধু ফাঁস করা হয়েছে বললে ভুল হবে। জড়িত চক্রটি রীতিমতো শিক্ষামন্ত্রীর পেটানো ঢাকঢোলকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আগাম ঘোষণা দিয়েই প্রশ্নফাঁস করেছে।
একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নফাঁস হওয়ার পরও কোনো পরীক্ষাই বাতিল করার কথা বলেননি শিক্ষামন্ত্রী। তা ছাড়া পরীক্ষা বাতিল করা হলে অভিভাবকরা রাস্তায় নামবেন এমন কথাও বলেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে তো সবাই পরীক্ষা দেয়নি। তাহলে কোন যুক্তিতে পরীক্ষা বাতিল করা হবে? ফলে এসএসসি পরীক্ষার পর সবকিছুই গর্জনের জালেই আটকে থেকেছে। তা ছাড়া প্রশ্নফাঁস হলেও তার দায়ভার সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ই নিতে রাজি নয়। একাধিক মন্ত্রণালয় শুধু দোষারোপ করেই দায়ভার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাই করেছে। তাদের এমন চেষ্টাতে আর যাই হোক, নেপথ্যের আসল চরিত্রগুলোর মুখোশ জাতির সামনে ফাঁস হয়নি।
এদিকে এইচএসসি পরীক্ষার আগে গত বুধবার মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যা বলেছেন, তা নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে প্রশ্নের সেট পরীক্ষার হলে নেওয়া হবে। তাতে করে প্রশ্নফাঁসকারীরা কিছুই করতে পারবে না। মন্ত্রীর এমন বাণী অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে ক্ষীণ আলো হয়ে দেখা দেয় কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে আজ থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হলে শিক্ষামন্ত্রী কোন দিকে হাঁটবেন?
একটি জাতির মেরুদণ্ড হচ্ছে শিক্ষা। যে জাতি যত শিক্ষিত হবে, সে জাতি ততই উন্নত। শিক্ষা ছাড়া উন্নয়নের জন্য আর কোনো মাপকাঠি রয়েছে কি না, সেটি কেউই বলতে পারে না। কেউ কেউ টাকার অঙ্কের হিসাবে বড়লোক এবং উন্নয়ন দেখেন। যদি উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে এটি বিবেচ্য হতো তাহলে তো পুরনো ঢাকার মাজেদ সরদার সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতেন।
১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী বছর ১৯৮০ সালের শেষদিকে এই মাজেদ সরদার নয়াবাজার এলাকায় বিএনপির জনসভায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপস্থিতিতে বক্তব্য রেখেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল এমন, ‘হেই পারের (কেরানীগঞ্জ) কথা হেই পারে। এই পারের (পুরনো ঢাকা) কথা এই পারে। কি কন প্রেসিডেন্ট ছাহেব?’ মঞ্চে উপস্থিত সবার মুখে হাসি। মাজেদ সরদারের এমন কথায় জিয়াউর রহমানেরও মুখে ছিল মুচকি হাসি।
একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে প্রথমেই শিক্ষা ব্যবস্থায় কুঠারাঘাত করতে হয়। যেমন একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে পাক সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতার হাফসেঞ্চুরির দ্বারপ্রান্তে এসে দেশ অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল স্বীকৃতি পেয়েছে, তখন জাতিকে পেছন দিকে টানা শুরু হয়েছে। প্রশ্নফাঁসের ক্ষত দিন দিন বড় হচ্ছে। আমাদের হাতে সময় খুব একটা বেশি নেই। দেশ ও জাতিকে রক্ষায় সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের অঙ্গীকার করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আর নয় প্রশ্নফাঁসকারীদের কোনো ছাড়। এরা চোরাচালানি, মাদক ব্যবসায়ী ও জঙ্গিদের চেয়েও দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য ভয়ঙ্কর অস্ত্র।
গত শনিবার বাংলা ট্রিবিউন তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছিল, এটা জানাজানি হওয়ার পর সরকার চরম অস্বস্তিতে পড়েছে। এ ঘটনা নিয়ে সরকার একটু বেকায়দায় আছে।
ভারতের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের প্রশ্নফাঁসের ঘটনার মিল রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে একটি কথা তো বলতেই হয়। প্রশ্নফাঁসকারী চক্রটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে কী এখন বিদেশেও এ কৌশল রপ্তানি করা শুরু করেছে?
সাকির আহমদ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
[email protected]