ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

১১৫ বছর বয়সেও ৫ ওয়াক্ত দেন আজান

দড়ি ও বাঁশ বেয়ে মসজিদে যান অন্ধ মুয়াজ্জিন

মো. জাহিদ হাসান, বড়াইগ্রাম (নাটোর)
🕐 ৬:৫৮ অপরাহ্ণ, মে ১৮, ২০২৪

দড়ি ও বাঁশ বেয়ে মসজিদে যান অন্ধ মুয়াজ্জিন

গ্রামীণ পাকা সড়ক বেয়ে নিয়মিত মসজিদে যান অন্ধ মুয়াজ্জিন আব্দুর রহমান মোল্লা (১১৫)। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও তার দৃঢ় মনোবল আর ইচ্ছা শক্তির কাছে সব কিছুই যেন পরাজিত। দীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ যাতায়াত করা পথচারী কিংবা যানবাহনে চলাচলকারী যাত্রীরা দাঁড়িয়ে দুচোঁখ মেলে দেখেন অন্ধ মুয়াজ্জিন মো. আব্দুর রহমান মোল্লার বাঁশ ও রশি বেয়ে রাস্তা পারাপার ও মসজিদে প্রবেশের দৃশ্য।

 

বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় ২০০ মিটার রাস্তা বাঁশ ও রশি টেনে নিয়েছেন মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান দেওয়ার জন্য। তার বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের বড়দেহা গ্রামে। চোঁখের দৃষ্টি শক্তি না থাকলেও মনের দৃষ্টি শক্তি ও মনোবল কমেনি তাঁর। অন্ধ মুয়াজ্জিনের এমন মহৎ কাজে খুশি পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী।

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ‘প্রায় ২০ বছর পূর্বে এক দুর্ঘটনায় দুই চোঁখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন আব্দুর রহমান মোল্লা। ২০ বছর পূর্বে থেকেই তিনি অন্ধ। পরিবারে রয়েছে দুই স্ত্রী ও ২৫ জন ছেলে-মেয়ে। তাদের মধ্যে ৬ জন মারা গেলেও বর্তমানে ১০ জন মেয়ে ও ৯ জন ছেলে এবং দুই স্ত্রী বেঁচে রয়েছেন। সকল সন্তানদেরই প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। করিয়েছেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষক, কৃষি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, সৈনিক, ব্যবসায়ী দুই একজন নিজের জমি-জমা দেখাশোনা করেন। অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ২০১১ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করে এসেছেন। হজ্ব পালন করে আসার পর থেকে নিজ এলাকা বড়দেহা গ্রামে নিজের পাঁচ শতাংশ জমির ওপর তৈরি করেন একটি পাকা মসজিদ। গ্রামের মানুষ ও ছেলে-নাতীদের নিয়ে ২০১১ সাল থেকেই নিজের স্থাপন করা মসজিদে নামাজ আদায় শুরু করেন। সেই মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসাবেও তিনি বিনাপারিশ্রমিকে দায়িত্ব পালন করছেন।’

আব্দুর রহমান মোল্লার ছেলে আলহাজ্ব মোঃ শফিকুল ইসলাম সাইফুল (মাস্টার) বলেন,‘২০ বছর পূর্বে একটি দুর্ঘটনায় তার বাবা অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ হওয়ার ৬ বছর পরে বাবাকে নিয়ে হজ্ব পালন করান। হজ্ব পালন শেষে তার বাবা যে মসজিদ স্থাপন করেছেন সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু বাড়ি থেকে মসজিদ প্রায় ২০০ মিটার দূরে। তাই বাবার ইচ্ছা পুরণ করতে বাড়ি থেকে বাঁশ ও রশি টেনে দেন মসজিদ পর্যন্ত। প্রথমে প্রায় ১৫ দিন ছেলে ও নাতিরা বাঁশ ও রশি দেখিয়ে দিয়ে মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন তাকে। পরে নির্বিঘ্নে বাঁশ কিংবা রশি খুঁজে পাওয়ার জন্য হাতে একটি লাঠিও দেওয়া হয়। তারপর থেকে তিনি নিজেই বাঁশ ও রশি বেয়ে রাস্তাপার হয়ে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান ও নামাজ আদায় করছেন।’

আরেক ছেলে রফিকুল ইসলাম (মাস্টার) বলেন,‘তার বাবা’র বয়স চলছে ১১৫ বছর। এই বয়সে এসেও অন্ধ হয়ে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান দেন এবং নামাজ আদায় করেন। বাবা’র এমন মহৎ কাজে তিনিসহ তার পরিবারের সকলেই অনেক খুশি। তাছাড়াও তার বাবা তার সকল ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি তার বাবার জন্য গর্বিত।

আলহাজ্ব মোঃ আব্দুর রহমান মোল্লা জানান, ‘মহান আল্লাহ পাক তাকে এখনও অনেক সুস্থ্য স্বাভাবিক রেখেছেন। কেটে গেছে ১১৫ বছর বয়স। দুর্ঘটনায় অন্ধ হয়ে গিয়েও তিনি নিজের মনোবল শক্ত রেখেছেন।নিজের জমিতে মসজিদ স্থাপন করে সেখানেই বিনাপারিশ্রমিকে মুয়াজ্জিন হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাঁশ ও রশি বেয়ে মসজিদে যেতে তার খারাপ লাগে না। যদিও রাস্তাপারাপারের সময় ঝুঁকি থাকে; তারপরও তিনি বিশ্বাস করেন আল্লাহ তাআলা তাকে হেফাজতেই তার গন্তব্যে পৌছে দিবেন। ছেলেমেয়েকেও প্রতিষ্টিত করেছেন, বিবাহ দিয়েছেন। এখন বাকি জীবন তিনি এভাবেই ইসলামের পথে থেকেই মৃত্যু বরণ করতে চান। তিনি সকল মুসলমানদের নামাজের দাওয়াতও দিয়েছেন।’

রাজশাহী নাজাত হাফিজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেজ মাওলানা মো. আব্দুল মজিদ বলেন,‘ আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসাল্লামের জন্য আজান দিতেন। আর তিনি ছিলেন অন্ধ। আব্দুর রহমান মোল্লা ১১৫ বছর বয়সে এসেও ইসলামের পথে যে মহতি কাজ করছে তার প্রতি মহান আল্লাহ পাক অবশ্যই সদয় হবেন। তার মনোবল অনেক দৃঢ়। তিনি অনেকের অনুপ্রেরণা হতে পারেন। তাকে দেখেও যারা নামাজে আগ্রহী হয়নি তারা অবশ্যই আগ্রহী হবেন।

 

 
Electronic Paper