ঢাকা, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অতি-অভিভাবকত্ব বা ওভার প্যারেন্টিং | সামিয়া আসাদী

অনলাইন ডেস্ক
🕐 ৪:১২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২২, ২০২৩

অতি-অভিভাবকত্ব বা ওভার প্যারেন্টিং | সামিয়া আসাদী

শুধু পুঁথিগত বিদ্যার পিছনে ছুটতে গিয়ে জীবনের অনেক জরুরী শিক্ষা থেকে সন্তানেরা ছিটকে পড়ছে। সব কিছু ছাপিয়ে সন্তানদের মানুষ করার নামে যে অতিরিক্ত অভিভাবকত্ব ফলাচ্ছি তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। প্রতিটি বাবা-মায়েরই মনের কথা এটি। সন্তানের মঙ্গল চিন্তায় নিবেদিত প্রাণ বাবা-মায়েরাই হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে, বিপত্তি ঘটে তখনই, যখন সন্তানের জন্য অতিরিক্ত ভালো চাইতে শুরু করি আমরা। নিজেদের যত্ন আত্তির দিকে থোরাই কেয়ার করে কেবল রাত-দিন সন্তানের পেছনে ব্যয় করতে থাকি। কথায় আছে, ‘অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না’। সন্তানের জন্য অতিরিক্ত মঙ্গল চিন্তা যে অমঙ্গলকে স্বাগত জানাতে পারে সেদিকে অনেক সময়ই উদাসীন থাকি। নিজেদের জীবনের না পাওয়াগুলো সন্তানের প্রাপ্তির খাতায় যোগ করতে গিয়ে মনের অজান্তেই যে সন্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকি তা চিন্তা করি না। শুধু পুঁথিগত বিদ্যার পিছনে ছুটতে গিয়ে জীবনের অনেক জরুরী শিক্ষা থেকে সন্তানেরা ছিটকে পড়ছে। সব কিছু ছাপিয়ে সন্তানদের মানুষ করার নামে যে অতিরিক্ত অভিভাবকত্ব ফলাচ্ছি তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে ।

সন্তান কি আইনস্টাইন হবে?
সেদিন এক মাকে দেখলাম, ছুটির পর বাচ্চা ক্লাস থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই মিস আজকে কী কী পড়িয়েছেন তা নিয়ে রীতিমত সওয়াল- জবাব শুরু করে দিয়েছেন। ডায়েরিতে পড়া ঠিক মতো তোলা হয়নি বলে বকা দিচ্ছেন। মাত্র ক্লাস থেকে ফেরা ক্লান্ত শিশুটি মায়ের প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে পুরোই মুষড়ে পড়েছে। এখনতো সন্তানের চেয়ে অভিভাবকদের প্রতিযোগিতা বেশি চোখে পড়ে। এক হালি কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার পাশাপাশি তমুকে গানের ক্লাসে ভর্তি হলো অমুকে তায়াকুন্দুতে ইয়োলো গ্রীণ বেল্ট পেয়ে গেছে ইত্যাদি পিয়ার প্রেসারে অভিভাবকদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সন্তান পিছিয়ে পড়ছে ভেবে সন্তানের মঙ্গল ভাবনায় নিবেদিত প্রাণ বাবা-মা। কোচিং, গানের ক্লাস, তায়াকুন্দুসহ যাবতীয় স্টিমরোলার চালাতে শুরু করেন। সন্তানের চাওয়া পাওয়া কিংবা নিতে পারার ক্ষমতার দিকে না তাকিয়ে এ প্রতিযোগিতা নির্ভর ছুটে চলায় যে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি তা ভাবতে চান না। সন্তানকে সায়েন্সই নিতে হবে। ডাক্তারই হতে হবে। এরকম ‘ই’ প্রত্যয় যোগ করে দেন অনেক বাবা-মাই। সন্তান কী চায় তার তোয়াক্কা না করে অনেক কিছুই চাপিয়ে দিতে চান। প্রতিটি বাবা-মাই সন্তানের মঙ্গল চান। এতে কোনো দ্বি-মত নেই। সমস্যার সৃষ্টি হয় তখনই যখন আমরা সব কিছুতে সন্তানকে শ্রেষ্ঠ দেখতে চাই। ভাবখানা এমন সবাইকেই আইনস্টাইন হতে হবে। এই আইনস্টাইন হওয়ার চক্করে, সন্তান কী চায়, সে কতটুকু নিতে পারবে সেদিক থোরাই কেয়ার করে বাবা-মায়েরা কেবল ছুটতে থাকেন। এখানেই শেষ নয়, অমুক আর তমুকের সন্তানের সাফল্য দেখে বার বারই নিজের সন্তানকে হেয় করতে থাকেন। আপনার এ ধরনের তুলনা সন্তানকে শুধু অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয় না, আত্মবিশ্বাসকে গুড়িয়ে দেয় যার পরিণতি আরো ভয়ঙ্কর। অথচ সন্তানদের শেখানো উচিত প্রতিযোগিতা যদি করতেই হয় তা হবে কেবল নিজের সাথে। নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিযোগিতা। না বুঝে এত যে ছুটছেন কখনো কি চিন্তা করেছন সন্তানকে ঘিরে আপনার প্রত্যাশার পাহাড়ে ধস নামতে পারে এক সময়! আপনার জীবনের অপূর্ণতাগুলো পূর্ণতা দেবার একচেটিয়া দায়িত্ব কেবল সন্তানের ঘাড়ে দেয়া শুধু অন্যায় না রীতি মতো অপরাধও। নিজের নাওয়া-খাওয়া, শখ-আহ্লাদ ভুলে সন্তানের পেছনে অতিরিক্ত সময় দিতে গিয়ে শারিরীক-মানসিক চাপ থেকেও অযাচিত প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে। পরবর্তীতে অতিরিক্ত প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার গ্লানিও যে ভোগ করতে হবে তা মাথায় রাখুন। শেষ পর্যন্ত যার যার জীবনের সিদ্ধান্ত সেই নিবে। সন্তানের জীবন গোছানোর দায়িত্বটা তাকেই নিতে দিন না। সন্তান সন্তান করে নিজের যে শখ আহ্লাদ বলি দিয়ে আসছেন সেগুলোর দিকে খানিকটা হলেও নজর দিন। এতে ফায়দা দুটো। এক, নিজের শখের যত্ন বা মি টাইম আপনাকে তুষ্টি দিবে। দুই, সন্তানের ওপর তৈরি হওয়া অতিরিক্ত প্রত্যাশাও লোপ পাবে। সন্তানের প্রতি তৈরি হওয়া অযাচিত অভিমান তখন আর ডাল-পালা গজানোর সুযোগ পাবে না।

রোগের নাম বিচ্ছিন্নতা:
আধুনিক সমাজে সবাই বিচ্ছিন্ন। নিউক্লিয়ার পরিবারে বেড়ে উঠছে সন্তানেরা। বাবা-মায়ের বাইরে দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-ফুফু, মামা-খালাদের সংস্পর্শ নেই বললেই চলে। এ বিচ্ছিন্ন বিলাসিতা আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে মানসিকভাবে যে পঙ্গু করে দিচ্ছে তা ভেবে দেখছি কি? বাবা-মায়েরা সন্তানদের যতই আগলে রাখুন না কেন তাঁদের পক্ষে অন্য সব সম্পর্কগুলোর ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি সম্পর্কই আলাদা। রং, রূপ, মাত্রা যেমন ভিন্ন তেমনি গতি, প্রকৃতি ভূমিকাও ভিন্ন। এক্ষেত্রে এক জনের বিকল্প আরেকজন হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা কেউই চির জীবন বেঁচে থাকবো না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সম্পর্কের স্মৃতিগুলোই থাকবে। কাজেই সম্পর্ককে আপন গতিতে চলতে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সম্পর্কের ভিতর তিক্ততা, মান-অভিমান থাকবেই। তাই বলে আত্মীয়তার সম্পর্ককে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা রক্ষা করতে না চাওয়া হবে চরম ভুল সিদ্ধান্ত। আসলে মাথা ব্যাথা বলে পুরো মাথাটাই কেটে ফেললাম এমন সিদ্ধান্ত নেয়া নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। কাজেই কেবল অভিযোগ আর অনুযোগের কাঠগড়ায় সম্পর্কগুলোকে না দাঁড় করিয়ে সহজ আর একটু উদারতার চোখে দেখতে পারলেই তো জীবন সুন্দর। সম্পর্ক রক্ষার জন্য সবাইকে এক ছাদের নীচে থাকতেই হবে বিষয়টা এমনও নয়। কাছে থেকে চিন্তা-চেতনায় অমিল কিংবা তিক্ততায় ভরা টক্সিক সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর চেয়ে দূরে থেকে স্বাভাবিক থাকা বেশি জরুরি। সদিচ্ছা আর সামান্য কিছু উদ্যোগই পারে কাছের সম্পর্কগুলো ঠিক রাখতে। যেমন- বছরে এক/দুবার পরিবারের সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া, নিজেরা নিজেরা বনভোজন করা, মুভি দেখতে যাওয়া, ছুটির দিনগুলো সবাই মিলে একসাথে কারো বাসায় কাটানো যেতে পারে। এতে করে নিজেদের মধ্যে বন্ধন যেমন বাড়ে তেমনি সম্পর্কের দূরত্বও কমে আসে। তার চেয়ে বড় কথা বাবা-মায়ের চোখে এড়িয়ে যাওয়া সন্তানের কোনো পরিবর্তন খুব সহজেই ধরা পড়ে পরিবারের অন্য সদস্যের চোখে। শিশুরা সম্পর্কের কদর করতে শিখে। জড়তা ভেঙ্গে মানুষের সাথে সহজে মেশার চর্চা রপ্ত করতে পারে। সর্বোপরি শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে বাঁচার ভিতরেই যে প্রকৃত সুখ তা অনুভব করতে পারে। একা থাকা আর শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবা, সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা রোগ থেকে মুক্তি পেতে কাছের সম্পর্কগুলোর কদর জরুরি। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের কাছের সম্পর্কগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া শেখানো। ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ হতে পারলেই যে প্রকৃত সুখ আসবে জীবনে সেই দীক্ষা সন্তানদের দেয়া বড্ড প্রয়োজন।

পারিবারিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই
ষাটোর্ধ্ব এক বাবাকে প্রায়ই দেখি বাজারের ভারী ব্যাগ হাতে বাসায় ফিরছেন। প্রথমে ভেবেছিলাম বাসায় সাহায্য করার মতো কেউ নেই, তাই হয়তো ওনাকেই বাজারে যেতে হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঘরে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে থাকার পরও শুধু বাজার করা নয়, ছেলেদের অফিসের টিফিন তৈরি করে দেয়াসহ মাঝে মাঝে কাপড় ধুয়ে আয়রণ পর্যন্ত নাকি করে দেন। পাছে ছেলেদের কষ্ট হয়। তাই এই বয়সেও এসব কাজ করতে নাকি ওনার ভালই লাগে। তার চেয়ে বড় কথা সংসারের এসব ঝুট ঝামেলা থেকে ছেলেদের দূরে রাখাকেই তিনি শ্রেয় মনে করেন। এ ভদ্রলোকের মতো সন্তানকে ঝুট-ঝামেলা মুক্ত জীবন দিতে চান অনেক বাবা-মাই। অতি আরাম-আহ্লাদ, ফুলের টোকাটি গায়ে না যেন লাগে প্রেক্ষিত তৈরি করে সন্তানদের বড় করতে চান। কিন্তু কন্টকপূর্ণ যাপিত জীবনের বাস্তবতা তো ভিন্ন। সন্তানকে যতই আপনার শীতল ছায়ায় রেখে আরাম দেন না কেন বাইরের কঠিন পৃথিবীর সাথে লড়াইটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে একাই লড়তে হয়। কাজেই জীবন লড়াইয়ের ধারাপাত ঘর থেকেই শুরু করা প্রয়োজন। ঘরের জন্য আলু-পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে যেমন ঘর সামলানো শিখবে তেমনি দেশের অর্থনীতির হাল-চালও বুঝতে পারবে। নিজের ঘর পরিস্কার করা, মেহমান আপ্যায়ন, ছোট-খাট রান্না, বিভিন্ন বিল দেয়াসহ নানা কাজে সন্তানদের অংশ নিতে দিন। এই ছোট ছোট অংশগ্রহণই একদিন বড় কাজ করার রসদ যোগাবে। শুধু কøাসের পড়ার বইয়ে মুখ গুজে জীবনমুখী শিক্ষা লাভ করা সম্ভব নয়। বরং পড়াশুনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক কাজে অংশ নেয়ার চর্চা শুরু করতে হবে। এতে করে চারদিক সামলিয়ে জীবনে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয় এবং নেতৃত্বের মৌলিক গুণাবলীর দীক্ষা ছোটবেলা থেকেই পাবে সন্তানেরা। চাহিবা মাত্র সন্তানের সব শখ পূরণ করতে পারলেই ভালো বাবা- মা হয়ে গেলাম তাও সব সময় সত্য নয়। মিনিমালিজমের চর্চা এখানে জরুরি। অল্পতে তুষ্ট থাকা, সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত থাকার চেষ্টা, নিজের শখগুলোর যত্ন নেয়া, মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন। জীবনে কেবল ভালো ছাত্র হওয়ার পিছনে না দৌঁড়িয়ে ভালো মানুষ হওয়ার চর্চা জারি রাখা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারকে হতে হবে এসব শুভ চর্চার সূতিকাগার।
বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখবো। সন্তানের জীবনে সফলতা আসুক বা কীভাবে তাকে তৈরি করবো তা নিয়ে অবশ্যই সঠিক পরিকল্পনা জরুরী। তবে প্যারেন্টিংয়ের নামে ওভার প্যারেন্টিং করে ফেলছি কিনা সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। সারা দিন সন্তানের পিছনে না থেকে তাকে কোয়ালিটি সময় দিন। তাদের আত্ম-নির্ভরশীল হতে সাহায্য করুন। সন্তানের প্রথম বিদ্যালয় হচ্ছে পরিবার। নৈতিক শিক্ষা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, আচরণ বিষয়ক শিক্ষা সন্তান বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শেখে। পরিবারে আপনি যে আচরণ করবেন আপনার সন্তান সেটাই শিখবে। কাজেই অভিভাবক হিসেবে সঠিক পথে আছি কিনা তা বিশ্লেষণ করা সবার আগে জরুরী। এক্ষেত্রে আত্ম-আলোচনার বিকল্প নেই। নিজেকে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করা প্রয়োজন আপনি ওভার প্যারেন্টিং বা অতি অভিভাবকত্ব ফলাচ্ছেন না তো? নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারলে প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নেয়া যেতে পারে।

সামিয়া আসাদী
সহকারী অধ্যাপক
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যায়ন
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper