ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রবীন্দ্র সংগীতে ম্যাজিক আছে

শ্রীকান্ত আচার্য
🕐 ৭:০৩ অপরাহ্ণ, মে ১৩, ২০১৮

সুরের ধারার ২৫ বছর পূর্তিতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। বাংলা গানের প্রথিতযশা এই শিল্পী সাক্ষাৎকার দিতে গররাজি ছিলেন। পীড়াপীড়িতে সময় দেন পাক্কা আধা ঘণ্টা, কথায় কথায় যা গড়ায় দেড় ঘণ্টায়। খোলা কাগজ-এর কাছে তুলে ধরেন সুর-সংগীত ও জীবনাভিজ্ঞতার সারাৎসার। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জগন্নাথ বিশ্বাস

(আজ দ্বিতীয় পর্ব)
কবির সুমনের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের সূত্রপাত কীভাবে?
আমি তখন চাকরি করি। এটা ১৯৮৯-৯০ সালের কথা। সুমনদা তখন পাকাপাকিভাবে জার্মানি থেকে ভারতে এসেছেন। আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে তার সঙ্গে আলাপ হলো। বাড়িতেও গেলাম। এরপর সুমনদার বাড়িতে মাঝে মাঝে গানের আসর বসত। সেখানে গাইতাম। এভাবেই আলাপের সূত্রপাত। তারপর সুমনদার অ্যালবাম বেরোল। (তোমাকে চাই, ১৯৯২)। রাতারাতি সুমনদা বাংলা গানের আকাশ-বাতাস ভরিয়ে তুললেন। আমি কিন্তু সুমনদার গান শুনেছি আরও আগে। ১৯৮১ সালের দিকে, তখন আমি কলেজে পড়ি।
ঘরোয়া পরিবেশে কবির সুমনের সঙ্গে গানের আড্ডার স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন..
সেই দিনগুলো ছিল অন্যরকম। ঘরোয়া পরিবেশে তাকে আমি বহুবার পেয়েছি। সুমনদার সাংগীতিক ব্যুৎপত্তি এবং জ্ঞান নিয়ে তো কোনো কথা নেই। সুমনদার সঙ্গে গানের আড্ডায় বসলে সমৃদ্ধ হওয়া যায়। মিউজিক সম্পর্কে সুমনদার এমন কিছু অবজারভেশন আছে, যা ইউনিক। অনেক কিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। এখনো সুমনদা যখন বলেন তাতে অনেক কিছু শেখার থাকে। তার দৃষ্টিভঙ্গিটাই আলাদা। বাংলা গানের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কেও অগাধ জ্ঞান। বাংলা গান সম্পর্কে সুমনদার পাসপ্রেক্টিভটা একেবারেই নিজস্ব। তার গানের দর্শনটা যদি বোঝা যেত, তাহলে আধুনিক বাংলা গানে সুমনদার ভূমিকা বুঝতে সুবিধা হতো। এমন একজন গুণী মানুষের সঙ্গে এক মঞ্চে কোনোদিন গান গাইতে পারব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
ঘরোয়া গানের আড্ডা নিয়ে তো আপনার আরও অনেক স্মৃতি আছে। শ্রীজাত (কবি) আপনি, জয় সেনগুপ্ত (সুরকার), শুভমিতা, লোপামুদ্রা এরা আড্ডায় বসে নতুন গানও তৈরি করেছেন.... আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম.... গানটা তৈরিতেও নাকি ঘরোয়া আড্ডার ভূমিকা ছিল?
সমমনাদের আড্ডায় এটা হয়। পাঁচ মিশালি গল্প আর সৃষ্টিশীলতা সমান তালে চলতে থাকে। জয়, আমি, জয়তী (চক্রবর্তী, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী), লোপা, শ্রীজাত, শুভমিতা.... আমাদের বন্ধুত্বের বৃত্তটা বেশ বড়। কোনো বিকাল বা সন্ধ্যায় কেউ একজন হয়তো ফোন দিয়ে বলল, ফ্রি আছ... চল গান নিয়ে বসি। কয়েকজন হয়তো কারও বাড়িতে বসলাম। গল্প বেশি হয় না। গান হয় খুব। সেই সময় কোনো নতুন গানের আদলও তৈরি হয়ে যায়। পরে আরও ভাঙা-গড়া চলে। এভাবে নতুন গান তৈরিও হয়েছে। তাছাড়া এ ধরনের ঘরোয়া আড্ডার ভেতর দিয়ে এক রকমের আদান-প্রদান চলে। পরস্পরকে চেনা যায়। মেন্টাল টিউনিং হয়। এখন আমাদের জীবনযাত্রার ধরনই এমন যে, প্রতিটা মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে পড়েছি। ফোন, ইন্টারনেটে অতি নির্ভরশীল আমরা প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ভাইব্রেশান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এতে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। কৃত্রিমতাও বাড়ছে। কিন্তু গান নিয়ে আমরা যখন বসছি, তখন হয়তো কেউ সুর তুলছে, তাতে কেউ কথা বসাচ্ছে... কিংবা লিরিকটা লিখে আবার কাটছে.... সব মিলিয়ে গান তৈরি হওয়ার এ পদ্ধতিটা.... এটা কিন্তু ভীষণ জীবন্ত একটা ব্যাপার। এটাই ক্রিয়েটিভ ভাইব্রেশান। এটা থাকা দরকার। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটা ভালো কিছু তৈরি করতে চাইলে আড্ডাটা দরকার। আমার মনে হয়, আইসোলেশানটা ভীষণ ক্ষতি করছে মানুষের। টাচ হারিয়ে ফেলছি আমরা। আড্ডা তা আবার ফিরিয়ে দিতে পারে। আমাদের আড্ডায় দেখেছি, কোনো কোনো দিন কিছুই হয় না, শুধু গল্প, হুল্লোড়... কিন্তু ওটারও দরকার আছে। ওতে ভাইব্রেশান হয়। আর তাতেই হয়তো পরের আসরে একটা গান তৈরি হয়ে যায়। এ কারণেই আমার মনে হয়, নির্ভেজাল আড্ডার প্রয়োজন।
‘ভয়েস অব আমেরিকা’য় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে আগে নিজেকে তার মধ্যে আবিষ্কার করতে হয়। সুরের চলন, কথার বৈভব না বুঝতে পারলে ঠিকভাবে গাওয়া যায় না... একজন সফল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে তার গানে নিজেকে আবিষ্কার করেন কীভাবে?
আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের গানে ম্যাজিক আছে, যে কারণে তার গান ভালো লাগে। আসলে এক-একজন এক-একভাবে রবীন্দ্রনাথের গান আবিষ্কার করেন। রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি যে প্রীতি, যে আকর্ষণ আমার মনে হয়, তা একটা বয়সের পরে অবিষ্কার করা যায়। একটা গান হয়তো ছোটবেলায়, কিংবা কৈশোরে শিখেছি। সেটাই যখন বয়স ৫০ পার হয়ে যাওয়ার পরে গাইছি, তখন সুরের চলন বা কথার দ্যুতি আবিষ্কার করতে পারছি। হঠাৎ গাইতে গিয়ে মনে হচ্ছে ও ম্যাজিকটা তাহলে এই। কখনো আবার কথা আর সুরের মায়ায় দুলতে দুলতে কিছু ধরতে পারছি না। কিন্তু এ ধরতে না পারারও একটা সম্মোহন আছে। রবীন্দ্র গানের অধরা মাধুরী ধরতে চাওয়ার আকর্ষণেই হয়তো বারবার গেয়ে চলছি। এমনটা হয়। আবার মঞ্চে কখনো কোনো গান গাইলাম। ভালও লাগল। কিন্তু বাড়ি এসে মনে হলো, কোথাও বা একটু অপূর্ণতা থেকে গেছে। পরের দিন গাওয়ার সময় অপূর্ণতার ফাঁকটা ভরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকে। তবু মন ভরে না। গাওয়ার সময় বারবারই মনে হয়, আরও কিছু করার ছিল। এই যে অতৃপ্তির দোলাচল। আরও নীবিড় করে গাওয়ার আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথের গানে থেকেই যায়। আবিষ্কার-পুনরাবিষ্কারের পথে সেই গান আরও নিজের করে পাওয়ার জন্য তাই বারবার না গেয়ে উপায় থাকে না। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের গানে চির নতুনের মতো অফুরান একটা ব্যাপার আছে। নিজের মধ্যে এ গানের অনুরণনটা একবার ধরতে পারলে বারবার গাইতে ইচ্ছা করবেই।
অন্য কোনো ভালো গান গাওয়ার ক্ষেত্রেও কি এমনটা হয়?
যে কোনো ভালো গানের ক্ষেত্রেই ফিরে ফিরে গাওয়ার ইচ্ছেটা হয়। কারণ ভালো গানের কম্পোজিশনটাই এমন যে, গাইতে ইচ্ছে করে। কারণ চিরকালীন যে কোনো গানেই অফুরান একটা ব্যাপার থাকবেই। নূতন মনে হবে। অশেষ মনে হবে। তাই বারবার গাইতেও ইচ্ছে হবে। তবে সব ভালো গান খুব বুঝে গাইতে হবে এমন যারা মনে করেন আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। ভালো গানও গাওয়ার আগে বোঝার চেষ্টা অবশ্যই থাকবে, তবে সবটুকু বুঝে গাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। কিছু জিনিস একটু রহস্যময় থাকুক না। ‘বোঝা না বোঝায় মেশা’র মতো। আমি বলতে চাইছি সব বুঝে ফেললে তো আমি গানের স্রষ্টাই হয়ে গেলাম। তা তো সম্ভব নয়। তাই মনে করি, চিরকালীন গানের তাননীবিড় রহস্যলোক একটু অধরা থাকলে ক্ষতি নেই।
রবীন্দ্রনাথের গান তো অনেকের কাছেই বিশেষ অবলম্বন। কিছুটা নিত্যদিনের অভ্যাসের মতোও (হ্যাবিট)। আপনার কাছে কেমন?
বিশেষ মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, হয়তো কিছু হারিয়েছি, বা কোনো অতৃপ্তি মনটাকে নাড়া দিচ্ছে এমন মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গিয়ে বিশেষ কোনো লাইন অবিষ্কার করেছি আমি। মনে হয়েছে, এটা বোধ হয় আমারই জন্য। আমি ঠিক জানি না কেন এমন হয়। মনটা হয়তো ভিজে থাকে। কিছুটা ভঙ্গুর বিপন্নতার ভেতর দিয়ে যাই বলেই হয়তো এমনটা হয়। ভাবতে থাকি রবীন্দ্রনাথের জীবনে কত ঝড় এসেছে, প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছেন তবু ভেঙে পড়েননি। উঠে দাঁড়িয়েছেন। শোকের দিনে গেয়েছেন... আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু। আমি, আপনি বলতে পারি.. হি ওয়াজ অ্যা সুপার হিউম্যান বিং... তার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হয় না। এটা মেনে নিয়েও বলতে ইচ্ছে করছে, কীভাবে এটা করতে পেরেছেন তিনি? আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু... গাইছেন কিন্তু পরে সঞ্চারীতে বলছেন... তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে... কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে... মাত্র দুটো লাইন, অথচ কী অসীম দোতনা। কত সহজে বললেন। কথাটা নিজের জীবনে ধরাটা কিন্তু সুকঠিন। উনি ধরে দেখিয়েছেন। আমরা যারা নিজেদের রবীন্দ্রভক্ত বলে দাবি করি তারা কি সারা জীবনে বিরোধ-সংক্ষোভে ‘তবুও শান্তি তবু আনন্দের’ মতো ইতিবাচক থাকতে পারি? যদি পারতাম তাহলে আমিও তো সুখে-দুখে রবীন্দ্রনাথের মতোই নির্ভয় থাকতাম। তা তো হচ্ছে না। আমি পলকা আঘাতেই ভেঙে পড়ছি। তাহলে রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে কী শেখাল? এ প্রশ্ন তুলে আমি বোঝাতে চাইছি কত বড় অবলম্বন হতে পারেন রবীন্দ্রনাথ। তবে নিজের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের আরও বেশি সংবেদনশীল হতে শেখায়। জীবনকে অন্যভাবে দেখতে শেখায়। আমরা সবাই তো সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলছি। হয়তো বছর কুড়ি পরে আমি থাকব না। এতদিন জীবনটাকে কীভাবে দেখেছি, বাঁকি কুড়ি বছরও সেভাবে দেখব কিনা রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে। নতুন করে দেখতে শেখায়।
‘আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম....’ এ গান তৈরির গল্পটা বলুন... লীলাময় পাত্রের লেখা সেই গানের পাণ্ডুলিপি তো আপনার কাছে এখনো আছে...
সম্ভবত ১৯৯৭ কী ১৯৯৮ সালের কথা হবে। তখন লীলাময় পাত্রের সঙ্গে আমার এবং জয়ের (সুরকার জয় সেনগুপ্ত) নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমি তাকে দাদা বলতাম। অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং মৃদুভাষী। সরকারি চাকরি করতেন। আমার গান ভালোবাসতেন। জয়ের সুর করাও পছন্দ করতেন। উনি যা লিখতেন তা ভীষণ কাচুমাচু মুখে লজ্জাবনত হয়ে এক কপি আমাকে আর অন্য কপি জয়কে দিতেন। মানে ১০টা গান দিলে কপি আমার কাছে ১০টা এবং জয়ের কাছে ১০টা থাকত। আমরা ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ ক্যাসেটের আগে রেকর্ড করেছিলাম ‘ছেলেটির নাম মেঘ’ বলে একটা গান। ওটা ছিল লীলাময় পাত্রের কথায় জয়ের সুরকরা প্রথম গান। ‘আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি’র পাণ্ডুলিপি দিয়ে যাওয়ার পর আমি আর জয় একদিন আড্ডা মারছি। সেদিন জয় মুখোরার দুটি লাইন সুর করে আমাকে শুনিয়েছিল। এরপর আর এগোয়নি। আমার কিন্তু প্রথম দুই লাইনের সুর ভালো লেগেছিল। আমি জয়কে তাগাদা দিতাম। জিজ্ঞাস করতাম কি সুরটা এগোল? জয় এই করছি, করব বলে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। এভাবে বছর শেষ। লীলাময়দা মাঝে মাঝে কাচুমাচু হয়ে আমাকে গানের কথা জিজ্ঞেস করতেন। আমি বলতাম জয় তো সুর করছে না। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন জয় আমার বাসায় এলো। সম্ভবত ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চের দিকে হবে। আমি ওকে হাতে পেয়ে বললাম.. জয় আজ কোনো কাজ নেই, তুমি আমার সামনে বসে গোটা গানটার সুর করে উঠবে। ও বসে সুর করল। পছন্দও হলো। এবং আমরা পূজাতে গানটা রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সুর করার চার মাসের মধ্যে গানটা রেকর্ড হলো। কিন্তু জয়ের কাছে সুর করার জন্য গানটা পড়ে ছিল প্রায় আড়াই বছর।

 
Electronic Paper