ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কেন এত ভেদাভেদ, উন্মাদনা

ওয়াসিম ফারুক
🕐 ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০২১

কেন এত ভেদাভেদ, উন্মাদনা

বাংলাদেশের ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়ে আমাদের যে গর্ব ছিল বিগত কয়েক বছরের নানান ঘটনা তা অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে। একেক উছিলায় একেকভাবে ভাঙনের ধাক্কা লাগছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দেশের কয়েকটি এলাকায় সাম্প্রদায়িক ছোবল হেনেছিল।

সিরাজগঞ্জের স্কুলপড়ুয়া পূর্ণিমা রানী শীলের কথা আজও আমরা ভুলে যাইনি। এরপর ২০০৬ পর্যন্ত বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এক পরিবারের ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যা ও চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যা।

এসব ঘটনার প্রতিটিতে প্রতিবাদমুখর ছিল আমাদের দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী জনগণ ও তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোকে তথাকথিত বলার আমার কাছে অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ছলেবলে কলে-কৌশলে যে কোনোভাবেই হোক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসা। ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় তারা দেশের সাধারণ মানুষকে কতই না রূপকথার গল্প শোনান। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সকলেই সেই রূপকথার রাক্ষসেই পরিণত হন।

আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে দেশীয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অপশক্তির কাছে আমাদের এই সম্প্রীতি মোটেও পছন্দ না। ওরা চায় ওদের মতোই আমাদের সম্প্রীতিতে শকুনের থাবা বসুক। তাই ওরা প্রায়ই ভর করে আমাদের দেশে লুকিয়ে থাকা শকুনের ওপর। মাত্র শেষ হলো এই অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। প্রথম দিক থেকে সুন্দর বর্ণিল আয়োজনে কাটছিল দুর্গাপূজার নানান উৎসব।

কিন্তু এই সুন্দরের মধ্যে কলঙ্ক আঁকে গত বুধবার (১৩ অক্টোবর) সকালে কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দিঘি পূজামণ্ডপে। কে বা কারা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে অবমাননাকর অবস্থায় মণ্ডপের একটি বিশেষ স্থানে রেখে যায়। আর এখান থেকেই শুরু। এর রেশ দেশের প্রায় অনেক জেলায়ই ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে চাঁদপুর নোয়াখালী লক্ষ্মীপুর চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় অনেক জেলাতেই দুর্গাপূজার বিভিন্ন আয়োজন শুধু বিঘ্ন হয়নি কোথাও কোথাও চলেছে নারকীয় তাণ্ডবও। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে একাধিক পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিন যুবক ও এক কিশোর নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন গত বুধবার রাতে ও একজন বৃহস্পতিবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে মারা যান।

এছাড়াও গত শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে তথাকথিত তৌহিদী জনতার নাম করে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের পূজামণ্ডপ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনাও ঘটায় দুর্বৃত্তরা। হামলায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের যতন কুমার সাহা নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। প্রতিটি মানুষের জীবন এক অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়েও একটি জীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে কেন এই অপমৃত্যু। যে মায়ের সন্তান যে বোনের ভাই যে স্ত্রীর স্বামী আর সন্তানের বাবার এমন করুণ মৃত্যু হয় তারাই জানেন এটা কত বড় শোকের! কুমিল্লার ঘটনার দিকে নজর দিতে হয়, রাতের আঁধারে কোনো না কোনো গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। এটা সত্য, আর যাতে আমাদের সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, সম্প্রীতির বন্ধনে যেন চিড় ধরে এটাই ছিল মূল লক্ষ্য। উপমহাদেশের অনেক দেশে থেকে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক শক্ত।

গত শুক্রবারে জুমার নামাজে ও আফগানিস্তানের কান্দাহারে মসজিদে বোমা হামলায় ৩৩ জন নিহত হয়েছে। পাকিস্তানের অবস্থাও একই ধরনের। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাম্প্রদায়িক অবস্থা সুবিধার না। সেখানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে সংখ্যাগুরু হিন্দু কট্টরপন্থী মৌলবাদীদের হাতে খুন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এই তো সেদিন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের দরং জেলায় একটি সুবিশাল শিবমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার পর সেই আশ্রয়চ্যুতদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালায়।

স্থানীয় সাংবাদিকরা পুলিশের গুলিতে অন্তত দুজনের মৃত্যু, কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর দিয়েছে। যা ভারতের মতো একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। তবে গণতন্ত্রের চেয়ে এখানে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে রাজনৈতিক স্বার্থপরতা ও ধর্মান্ধতা। একটি ধর্মভিত্তিক উগ্র রাজনৈতিক দল যেভাবেই জনগণের ভোট নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা কখনই সাধারণ জনগণ ও রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য নিয়ামক হতে পারে না।

আমাদের দেশের কথায় চলে আসি। নিজ ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার না করে অন্যের ঘরের গন্ধ শুঁকে লাভ কী? যে গন্ধ শুঁকছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভায় বিরোধীদলীয় প্রধান ও বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেছেন, বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হামলা থেকে ‘সনাতনী জনগণ?’কে রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে। জানি না তিনি মোদিকে কী পদক্ষেপ নিতে বলেছেন? আমরা বাংলাদেশের মানুষ শুভেন্দু অধিকারীদের বলতে চাই, আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। আর সেই চেতনা থেকেই আমাদের অগ্রজরা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছেন। তাই আপনাকে আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না শুভেন্দু অধিকারী। আপনারা আগে নিজেদের ঘরের আবর্জনা পরিষ্কারের চেষ্টা করুন। নিজেদের দুর্গন্ধমুক্ত করার চিন্তা করুন। গত মাসে আসামের দুজন মুসলমান হত্যার পর আপনাদের চেতনা কোথায় ছিল? এর আগে যে ভারতে এত ঘটনা ঘটল তখন কেন নিজ ঘরের গন্ধ পরিষ্কারের চেষ্টা করেননি?

আমাদের দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীই ক্ষমতায় আসার জন্য বা ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য ধর্মকে একটি বিশেষ পুঁজি করে রেখেছে। গুজব আছে, আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নাকি আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক! এটা আমার কাছে একটা আজব কথা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। যদি এমনটিই হতো তবে কীভাবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বা নিতাই রায় চৌধুরীর মতো মানুষরা বিএনপির মন্ত্রী-এমপি হন। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী নাকি তার এলাকায় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন হিন্দুদের। এরপরও ২০০১ সালে ওই একই অভিযোগ এনে আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেশের অনেক জায়গার নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।

এরপর একযুগের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে তারপরও কি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন কোনোভাবে কমেছে? ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর খ্যাত রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলা চালায় দুষ্কৃতকারীরা। পরে দেখা গেল ওই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ বিএনপি দলীয় কর্মীদের সম্পৃক্ততা আছে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের পর বাংলাদেশের যশোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, চট্টগ্রাম, মাগুরা এবং সাতক্ষীরায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চলে। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় সংখ্যালঘুদের কয়েকশ’ বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অনেকেই এরপর নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান প্রাণভয়ে। যশোরের অভয় নগরের চাপাতলা গ্রামের মালোপাড়াতেও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছিল নির্বাচনের পরপর।

এরপর নানান অজুহাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হামলার শিকার হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। এর মধ্যে সর্বাধিক সমালোচিত ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলার ঘটনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, এই নাসিরনগর হামলার চার্জশিটভুক্ত দুই আসামিকে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ। যদিও পরবর্তী সময়ে নানান সমালোচনার মুখে তাদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়। শুধু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানই নন, অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পত্তি জবরদখল নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। গত জাতীয় নির্বাচনে ঠিক পর মুহূর্তে ফরিদপুরে বিজয়ী সংসদ সদস্যের সমর্থকরা হামলা চালায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িতে।

সুনামগঞ্জের ঝুমন দাসের কথা আমাদের সবারই জানা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমন ঠেকাতে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের প্রতিবাদে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী গোষ্ঠী যখন পুরো দেশে অরাজক পরিস্থিতি তখনই নাকি আল্লামা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। এই ঘটনায় সম্পৃক্তদের কারও কারও সরকারি দলের স্থানীয় রাজনৈতিক পরিচয়ও মেলে।

অথচ এই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে আমাদের অগ্রজরা মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় চেয়ারে বসার জন্য বিভিন্ন সময় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে নানানভাবে তাল মিলিয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। অথচ এই খেলাফত মজলিসের তৎকালীন প্রধান শায়খুল হাদীস আল্লাম আজিজুল হক নিজেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কথা স্বীকার করেছেন। এরপর তথাকথিত হেফাজতে ইসলামকে খুশি রাখার জন্য পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনসহ কত কিছুই না করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের কিছু লোক নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ও বহাল তবিয়তে সমাজে বসবাস করছে রাজনৈতিক দলের ছায়া তলে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে সেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা মুখের বুলি ছাড়া কিছুই না।

তবে আজও আমাদের সাধারণ মানুষের ভিতরে সম্প্রীতির কমতি আছে বলে আমার কাছে খুবই কম অনুভব হয়। আজও গ্রামে গেলে বাল্যবন্ধু বলহরির সঙ্গে দিনরাত আড্ডা দিই। বিজয় নানার কাঁধে হাত দিয়ে ঘুরে বেড়াই। যে কোনো প্রয়োজনে বন্ধু কৃষ্ণকে রাতদুপুরে কল করি। শরীর অসুস্থতার খবর শোনা মাত্রই জাপান থেকে ফোন করে শারীরিক খবর নেয়। তবে কেন এই সাম্প্রদায়িক অশান্তি? এর উত্তর আমাদের সাধারণ মানুষের জানা আছে বলে ধারণা নেই।

লেখক : কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper