ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কামরান : একজন জননেতার প্রতিকৃতি

ফকির ইলিয়াস
🕐 ৮:০৬ অপরাহ্ণ, জুন ২৩, ২০২০

সিলেটের চৌহাট্টা পয়েন্টকে ‘বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান’ চত্বর ঘোষণা দেওয়া হোক। সিলেটে নতুন যে হাসপাতালটি সরকারি খরচে নির্মাণ করা হচ্ছে সেটির নাম মেয়র কামরানের নামে করা যায় কিনা তা ভাবা হোক। তা সম্ভব না হলে, সিলেটে একটি বড় স্থাপনার নাম মেয়র কামরানের নামে করা হোক। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানের মা মারা গিয়েছেন। কামরান তখন কুমিল্লা জেলে। তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়, মায়ের দাফনে অংশ নেওয়ার জন্য। তিনি দাফনে অংশ নেন। অঝোরে কেঁদেছিলেন সেদিন। আবার তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল কারাগারে। ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা ‘রাঘব বোয়াল’ ধরার নামে বাংলাদেশকে রাজনীতিশূন্য করতে চেয়েছিলেন। সেই পটের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব ফখর উদ্দিন আহমেদ এবং জেনারেল মঈন উদ্দিন আহমেদ এখন আমেরিকায় থাকেন। দেশ তাদের রাখেনি কাছে!

আরেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার বারীও থাকেন আমেরিকায়। তারা বিভিন্ন জনকে হায়ার করে কিংস পার্টি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলার মানুষ তা গ্রহণ করেননি। গ্রহণ করেছিলেন, কামরানের মতো জননেতাদেরই। কামরান, জেলে থেকেই বিপুল ভোট বেশি পেয়ে পাস করে বেরিয়ে এসেছিলেন। মাটিবর্তী নেতা ছিলেন তিনি। তৃণমূল থেকে উঠে এসেছিলেন। তাকে ঘিরে আমার স্মৃতি অনেক। কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরে তাকে সম্মান জানাতে চাই।

বিকেল গড়িয়ে পড়েছে। খুব তাড়া করে পৌর ভবনের সদর দরজা দিয়ে ঢুকছি। খুবই জরুরি প্রয়োজন। কিছু লিগ্যাল ডকুমেন্টস প্রস্তুত করতে হবে। গেটেই তার সঙ্গে দেখা। ‘আমার কবি! কই যাইতা’।

‘ভাইজান, আপনার দরবারে!’ আমি বলি।

জড়িয়ে ধরেন আমাকে। ‘কিতা করতাম পারি, কবি!’

আমি আমার দরকারের কথা খুব সংক্ষেপে বলি। তিনি তার পিএস’ কে বলেন, ‘কাগজগুলো রেখে দেও।’

আমাকে সহাস্যে বলেন, ‘একটা জরুরি মিটিং আছে, কবি। আমি সরি, বইতে পারলাম না বলে। দুইদিন পরে আইয়া কাগজগুলো নিয়া যাইবা। আর সময় নিয়া আইবা, কথা আছে। ফোন দিবা আমারে।’

সিলেট পৌরসভায় তখনও সিটি করপোরেশন হয়নি। তিনি চেয়ারম্যান। বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান। একজন জননেতা। এই ছিলেন আমাদের কামরান ভাই! দুদিন পরেই তার অফিসে যাই। বলেন, ‘আজ সময় আছে কবি! বউকা, প্রাণ ভইরা মাতি।’ তারপরে দীর্ঘ কথাবার্তা। দেশ-পরবাস অনেক কিছুই।

অগ্রজ প্রতিম বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেই ১৯৭৪ সালে। গাজী চাচার (দেওয়ান ফরিদ গাজী) লামাবাজারের বাসায়।

দেওয়ান ফরিদ গাজীকে আমাদের এলাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে আনার জন্য দাওয়াত নিয়ে কয়েকজন গিয়েছিলাম। গাজী চাচা আমার আব্বা-চাচাদের বন্ধু। তারা একে অপরকে ‘ভাইছাব’ ডাকতেন। এরপরে কামরান ভাইকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে খুব কাছে থেকেই। বিভিন্ন প্রয়োজনে তার পরামর্শ চেয়েছি সেই কলেজ ছাত্র জীবনে। তার মাঝে যে বড় গুণটি ছিল, তা ছিল হাত তুলে ‘রাখো রে-বা’ বলে অনুজদের উত্তেজনা থামিয়ে দেওয়ার দক্ষতা। জানিয়ে রাখি ১৯৭৪-১৯৮০ সময়ে সিলেটে ছাত্ররাজনীতিতে একটা মিনিমাম রেসপেক্ট ছিল। আর পারস্পরিক সম্মানবোধই ছিল ছাত্রসমাজের বড় সৌহার্দ্য ও সৌন্দর্য।

মেয়র কামরানের কোন বিষয় বাদ দিয়ে কোনটি লিখব! লিখতে আমার হাত কেঁপে উঠছে। হাত কাঁপছে এজন্য যে ক’জন জননেতা ‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি!’ বলে সাহসের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন, এমনই একজন মানুষ ছিলেন কামরান। ‘হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’ কথাটি আজকাল ক’জন রাজনীতিক উচ্চারণ করতে পারেন! শুধু আমি নই, বাংলাদেশের কোটি মানুষ সেই সাক্ষ্য দেবেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, কামরান জন্ম নিয়েছিলেন গণমানুষের কাজ করার জন্যে। তাদের পক্ষেই তিনি থেকেছেন আজীবন।

উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই ১৯৭৩ সালে ৬৪২ ভোট পেয়ে তৎকালীন সিলেট পৌরসভার ৩ নম্বর তোপখানা ওয়ার্ড থেকে দেশের সর্বকনিষ্ঠ পৌর কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। কলেজে পড়ার সময়, আমাদের স্যাররা তাকে ‘কমিশনার সাব’ ডাকতেন! আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, তিনি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি তো জনপ্রতিনিধি! তাই শিক্ষকরাও তাকে সেই সম্মানই দিতেন। ১৯৭৩ সালে কামরান প্রথম যখন পৌরসভার কমিশনার হন তখন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন বাবরুল হোসেন বাবুল। এরপরের বার পৌর চেয়ারম্যান হন অ্যাডভোকেট আ ফ ম কামাল। পরবর্তীকালে পৌরসভা ও সিটি নির্বাচনে এ দুই চেয়ারম্যানই পরাজিত হন কামরানের কাছে। ১৯৭৩ সাল থেকেই কামরান সিলেট পৌরসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েন।

১৯৯৫ সালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপরে আর থেমে থাকেননি তিনি। ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান। ২০০৩ সালে প্রথম সিটি নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থীকে হারিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাসে নাম লেখান তিনি। মেয়র পদে তিনি ২০ মার্চ ২০০৩ থেকে ৪ আগস্ট ২০০৮ এবং পুনরায় ৪ আগস্ট ২০০৮ থেকে ১৫ জুন ২০১৩ পর্যন্ত মানুষের কাতারে ছিলেন। এরপরেও তার গণ-সম্পৃক্তি থেমে থাকেনি।

কামরান ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা মানুষ। নিজে বাউল গান গাইতেন। এক গহীন বাউল পরান বাস করত তার মনের সমুদ্রে। একটি ঘটনা মনে পড়ছে। সিলেটে তখন মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিছু মৌলবাদী ঘোষণা দিলেন, তারা হযরত শাহজালাল (র.)-এর ওরসে আউল-বাউলদের আসতে দেবেন না! খুব সম্ভব তা ছিল, ২০০২ সাল। আমি তখন বিদেশ থেকে দেশে অবস্থান করছিলাম। আমরা কয়েকজন ?তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ‘বাউল ফকিরের দেশ, আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট। এখানে আমাদের কে ঠেকাবে!’

মনে পড়ছে, ওরসের শুরুতেই এয়ারপোর্ট রোড থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে বাউল ফকিররা দরগাহের পূর্ব গেট দিয়ে এসে ঢুকলেন মাজার প্রাঙ্গণে। এর নেতৃত্বে প্রথম সারিতেই ছিলেন মেয়র কামরান। পেছনে মাথায় লালসালু বাঁধা হাজারো বাউল ফকিরের শিঙার ধ্বনি। ‘জুল্লে জালাল-শাহজালাল’ ধ্বনিতে মুখরিত সিলেটের আকাশ বাতাস ছিল সেদিন। চাঁদের হাট দিয়েই সাংস্কৃতিক পরিম-লে তার শুরু। তা ধরে রেখেছিলেন, জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। আরেকটি ঘটনা বলি। সিলেট বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন চলছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিউইয়র্কে এসে ১৯৯৩ সালে একটি সমাবেশে বলেন, ‘কীসের সিলেট বিভাগ! সিলেট বিভাগের আদৌ কোনো যৌক্তিকতা নেই’।

আমি সেই মিটিং কভারিংয়ে ছিলাম। ওইদিন বিকেলেই নিউজটি আমি দৈনিক সিলেটের ডাক-এ ফ্যাক্স করে পাঠাই। পরের দিনই নিউজটি সিলেটের প্রধান প্রতিটি দৈনিক সিলেটের ডাক, আজকের সিলেট, সিলেট বাণী, জালালাবাদ-সহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে ‘নিউইয়র্ক থেকে ফ্যাক্স যোগে ফকির ইলিয়াস’ বরাত দিয়ে ছাপা হয়। এরপরেই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। পরের ঘটনা পরিক্রমা অনেকেরই মনে আছে। ১৯৯৫ সালে ‘সিলেট বিভাগ’ -এর ঘোষণা দেয় সরকার। ওই বছরই আমি বাংলাদেশে যাই। সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে সিলেট গণদাবি পরিষদ, বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদ যৌথ উদ্যোগে একটি বড় জনসভার আয়োজন করে। হাসান মার্কেটের পশ্চিম গেটে ছিল প্যান্ডেল। আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার পর পরই শ্রদ্ধেয় কামরান ভাই আমাকে সেই সভায় পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই সেই ফকির ইলিয়াস, যিনি আমাদের জন্য প্রথম প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বলা নিউজটি পাঠিয়েছিলেন!’ পরে আমি সেখানেই বক্তব্য রাখি।

এই যে সম্মান তা কি কোনোদিন ভোলা যাবে! বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তার শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার গেঁথে থেকেছিল! তা তিনি বয়েই বেড়াতেন। তাকে জেলে ঢুকিয়েছিল ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা। রাজনীতি বাদ দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো সেই কামরান যিনি জেলে থেকেই মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঠেকানো গিয়েছিল কি? না, যায়নি। পরবর্তী সময়ে তিনি মেয়র পদে পাস করতে পারেননি। কেন পারেননি তা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকলেরই জানার কথা।

আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ হারাতে পারে না তা তো বারবারই প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে। আমি সে বিষয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না। তবে রাজনীতি থেকে ‘মেয়র কামরান’কে সরানো যায়নি আমৃত্যু। সিলেটে আমার দুজন অগ্রজের বিশেষ পরিচয় আছে। ‘চেয়ারম্যান বাবুল’ (বাবরুল হোসেন বাবুল) আর ‘মেয়র কামরান’। এই দুই পরিচয় কখনও মোছা যাবে না। কামরান ভাই নিউইয়র্কে এলে, আমি বলি, আপনি এখনও মেয়রই। তিনি হাসেন। আমি বলি, ‘জানেন তো এখনও ‘প্রেসিডেন্ট কার্টার’, ‘প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন’, ‘প্রেসিডেন্ট বুশ’ বলা হয়। কারণ এরা এই দেশের সকল গোপন বিষয় জানেন। আর জানেন বলেই এখনও সিক্রেট সার্ভিস তাদের পাহারা দেয়!’

তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘আপনি তো দেখি আমাকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বানিয়ে ফেলছেন!’ আড্ডার অন্যরা বলে ওঠেন, ‘আপনি আমাদের মেয়রই তো’!

এই ছিলেন জননেতা কামরান। বলতেন, আমি তো ক্ষমতায় নেই। তারপরও আপনারা প্রবাসীরা আমাকে ডাকবেন দরকার হলেই। আমি আপনাদের জন্য সাধ্যমতো যা পারি করব। ২০১৮ সালে এমন কথাই তিনি আমাকেও বলেছিলেন সিলেটে। তার মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি। সিলেটবাসী তা কীভাবে পোষাবেনÑ আমি জানি না। তবে তার সাহস ও শক্তি আমাদের মনে রাখতে হবে। সম্মান জানাতে হবে।

আমি আমার এই লেখায় প্রস্তাব করতে চাই, সিলেটের চৌহাট্টা পয়েন্টকে ‘বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান’ চত্বর ঘোষণা দেওয়া হোক। সিলেটে নতুন যে হাসপাতালটি সরকারি খরচে নির্মাণ করা হচ্ছে সেটির নাম মেয়র কামরানের নামে করা যায় কিনা তা ভাবা হোক। তা সম্ভব না হলে, সিলেটে একটি বড় স্থাপনার নাম মেয়র কামরানের নামে করা হোক। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

কামরান সিলেটের মানুষের জন্য জানবাজি রেখে কাজ করেছেন। সাহায্য করতে গিয়ে নিজে কোভিড- ১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। আসুন আমরা তাকে যথাযথ সম্মান জানাই। তা করতে না পারলে তো নিজেরাই বড় অকৃতজ্ঞ থেকে যাব। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল মানুষে মানুষে।

ফকির ইলিয়াস : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক

[email protected]

 
Electronic Paper