দেশপ্রেমিক ‘শহীদুল্লাহ ভাই’
শুভ কিবরিয়া
🕐 ৯:৩১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৭, ২০১৮
খুলনার দৌলতপুরে ১৯৩১ সালের ৩১ জুলাই জন্মেছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ও জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ৮৭ বছর পেরিয়ে এখনো কর্মবীরের ভূমিকায় নিজেকে সচল রেখেছেন। ফোনে জানতে চাইলাম কেমন আছেন? বললেন, ‘ভালো, খুব ভালো’। এই হচ্ছেন আমাদের শহীদুল্লাহ ভাই।
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর দুই জীবন। এক তার পেশাগত জীবন। সেখানে তিনি অনন্য মেধায়, অসাধারণ দক্ষতায়, সততা, নিষ্ঠা ও শ্রমে দেশের প্রকৌশলী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিজেকে আসীন করেছেন। অন্য জীবনে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মাঠের মানুষ। জনকল্যাণে রাজনীতির জন্য নিবেদিত। দেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষার আন্দোলনে উৎসর্গীকৃত। নিজে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সদস্য নন। কিন্তু বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল। এ সহানুভূতি শুধু দার্শনিক, আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, আর্থিকও বটে। এখনো প্রতি মাসে তিনি যা আয় করেন, তার তিন ভাগের দুই ভাগ এ কাজে ব্যয় করেন। তীব্র কঠোরতা আর হৃদয়বান কোমলতা এ দুইয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ-সমাজ বদলের লড়াইয়ে রত তরুণ সমাজের একটা বড় অংশের কাছে প্রেরণা আর ভালোবাসাময় শ্রদ্ধার ‘শহীদুল্লাহ ভাই’ হয়ে আছেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, নানারকম সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিকে প্রকাশ্য ও গোপনে আপনি বহু বছর ধরে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এলেন। এ ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী? ফলাফল কী? শহীদুল্লাহ ভাই উত্তর দিলেন, ‘খুব সুন্দর অভিজ্ঞতা। এটা খুব কাজে দিয়েছে। আমি একা যে কাজটা করতে পারতাম না, এখন সবাই মিলে তা করি।
এই কাজটা সবাই মিলে করাটা খুব দরকার। একজনের কাজে তো হবে না। সে জন্য এই প্রচেষ্টাটা খুবই কাজে লেগেছে। আমার যেটুকু অর্থ ব্যয়, যেটুকু শ্রমব্যয় এগুলো যত বেশি মানুষের ভেতরে শেয়ার করতে পারি ততই মঙ্গল। একা কতটুকু করা যায়। একা কিছুই করা যায় না। সে জন্য এটা একটা শেয়ারড এক্সপেরিয়েন্স। সবাই যেন মঙ্গলটা পায়। আমার ব্যর্থতা হচ্ছে, আরও বেশি পারলাম না কেন?’
আমার কৌতূহল বাড়ল। প্রশ্নটা করেই ফেললাম, যেসব জায়গায় এভাবে সহায়তা করেছেন তা ব্যর্থ হয়নি কোথাও? এবার শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর আত্মবিশ্বাসী উত্তর, ‘এটা ফেইল করার জিনিস না। এটা তো এমন না যে, কাউকে বিশ্বাস করে কিছু টাকা দিলাম, সে আর ফেরত দিল না-এরকম ব্যাপার তো না। জনগণকে বিশ্বাস করা, এই বিনিয়োগ কোনো দিন ফেইল করে না। মানুষের মঙ্গলের জন্য বিনিয়োগ কোনো দিন ফেইল করে না। মানুষের কল্যাণের জন্য যে কোনো প্রচেষ্টার সঙ্গে থেকে, তাকে সাহায্য করা কোনো দিন ফেইল করতে পারে না। এই ইনভেস্টমেন্ট কোনো দিন ফেইল করতে পারে না।’
০২.
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্প্রতি ৮৮ বছরে পা রেখেছেন। এখনো তিনি সক্রিয়। ধুমসে চালিয়ে যাচ্ছেন পেশাগত কাজ। এই দীর্ঘায়ু ও দীর্ঘ কর্মজীবনের মাজেজাটা কী? জানতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে। তিনি জানালেন, ‘এটা সোজা। আমি পেশাগত কাজ যেগুলো পারি অন্য অনেকে সেগুলো পারে না। আমাকে রিলাই করে বেশি। আমার পেশাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা এগুলোর জন্য আমার কাছে আসে। এ জন্য আমার কাজের অভাব নেই। আর আমি যতদূর সম্ভব যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, নিরপেক্ষতা সহকারে পেশাগত কাজ করি এবং নিজের কাছে যথেষ্ট সন্তুষ্ট, সেই তুষ্টিই বোধহয় আমাকে কিছুটা দীর্ঘায়ু দিচ্ছে। যদি নিজের কাজের ভেতরে ডুবে থাকা যায় এবং কাজটা উপভোগ করা যায় তাহলে হয়তো দীর্ঘায়ু পাওয়া যেতে পারে।’
তাহলে আপনার শক্তির উৎসটা কোখায়? আমার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই তিনি শুরু করলেন, ‘নীতিবোধ। এটা আমার পরিবার থেকে পেয়েছি। সেই নীতিবোধ থেকেই শক্তিটা আসে। সাধারণত মনে করা হয় যে জীবনে দুটি উপায় আছে। একটা উপায় হলো, অর্থ উপায় করা, যে কোনোভাবেই হোক। যেদিকে মুনাফা সেদিকে ধাবিত হওয়া। আরেকটা উপায় হলো, মানুষের সেবা করা। এই দুটির মধ্যে যারা সেবার পথটা বেছে নেয়, তাদের ভেতরে একটা শক্তি থাকে। যেমন আমি মৃত্যুর সময়ে একদম হতাশ হব না। এ জন্য যে আমি আমার নিজের প্রতি সৎ ছিলাম, নিষ্ঠাবান ছিলাম এবং সমাজ থেকে যা নিয়েছি সমাজকে সেই পরিমাণ ফেরতও দিয়েছি। এই তুষ্টি আমার আছে।’
০৩.
আর্থিকভাবে দরিদ্র স্কুল শিক্ষক পিতার ঘরে জন্মালেও অসম্ভব মেধাবী ছিলেন শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৪৬ সালে খুলনার দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে আরবিতে লেটার মার্কসসহ প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ব্রজলাল একাডেমি (পরে বিএল কলেজ) থেকে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৯তম স্থান অধিকার করে আইএসসি পাস করেন। ১৯৫০ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে বিএসসি পাস কোর্সে ডিসটিংশনসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের মধ্যে ২য় স্থান অধিকার করেন।
পরবর্তী সময়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তৎকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৭৯ শতাংশ মার্কস পেয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন প্রিন্সিপাল ড. এম এ রশীদের অনাগ্রহে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগদান করতে পারেন নাই।
এরপর তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তান ইরিগেশন ডিপার্টমেন্ট, জি কে প্রজেক্টের ডিজাইন অফিসে ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।
পরে কর্ণফুলী হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্টে চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে নানা জায়গায় কাজ করার পর স্থপতি মাযহারুল ইসলামের সঙ্গে পার্টনারশিপে বাস্তুকলাবিদ নামে পরামর্শক ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না জড়ালেও পিকিংপন্থী মার্কসবাদীদের প্রতি দুর্বল হন এবং তাদের কাজকর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। ৯ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে মার্কসবাদী পত্রিকা ছাপিয়ে গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার পিলখানার গেটের সামনে গ্রেপ্তার হন এবং তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
বিচার শুরু করতে বিলম্বের দরুন হাজতে সাড়ে পাঁচ মাস অবস্থান করতে হয়। সামারি মিলিটারি কোর্টে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ডিভিশন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁকে ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্দিষ্ট কনডেম সেলে সাধারণ কয়েদিরূপে অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়। এরপর বিভিন্ন জেলখানায় বন্দি থাকেন। অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকার কেন্দ্রীয় জেল থেকে ছাড়া পান।
জেলে থাকাবস্থাতেই মাযহারুল ইসলামের উদ্যোগে বাস্তুকলাবিদ থেকে অপসারিত হন।
তারপর শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামের প্রকৌশল পরামর্শক ফার্মের সৃষ্টি করেন। প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নে তীব্র মতান্তরের ফলশ্রুতিতে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে ভাঙন দেখা দেয় ১৯৯৮ সালে। এ বছরই প্রতিষ্ঠা করেন শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস নামের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
১৯৯৮ সালেই সর্বসম্মতিক্রমে তেল-গ্যাস কমিটির আহ্বায়কের পদ গ্রহণ করেন। ‘জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি’ গঠন করা হলে সর্বসম্মতভাবে এই কমিটির আহ্বায়ক পদ গ্রহণের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। এখনো এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করছেন।
০৪.
সততা, মেধা, নিষ্ঠা আর দেশপ্রেমের অনন্যতায় এক অনড়, কর্মঘন, আদর্শবাদী জীবন শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর লক্ষ্য। কোনো বিঘ্ন, বাধাই তাঁকে টলাতে পারে নাই। সত্য উচ্চারণে দৃঢ়সংকল্প তার জীবনের পাথেয়। কোনো ভনিতার ধারও তিনি ধারেন না। রাজনৈতিক জীবনে সমাজবাদী সমতার আদর্শে অবিচল তিনি। মনে করেন সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্র, সমাজ না এগুলো মুনাফাবাদী চেতনা সব বিনাশের কারণ হবে। তবে, তিনি লড়াইয়ের পক্ষপাতী, হাল ছাড়ার পাত্র নন।
তিনি মনে করেন, কর্মেই মুক্তি। ফলাফলের জন্য হা-পিত্যেশ করা মূর্খতা। মনে করেন, কর্ম করে যাওয়াতেই আনন্দ। ফল কতদূর লাভ হলো কি না হলো সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিষ্পৃহ, উদাসীন থাকা উচিত। একজন মানুষ সৎকর্মে নিয়োজিত থাকলে তা থেকে আনন্দ পাবে। এটাই তার ফললাভ। অন্য কী উপার্জন হলো, কী লাভ হলো তার কোনো দরকার নেই। তাঁর প্রতীতি হচ্ছে, আনন্দবোধটা কর্মের থেকে আসবে, ফলের থেকে নয়।
শুভ কিবরিয়া : নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
[email protected]