প্রকৃতির কান্না-হাসি
আঁখি রানী দাস তিতলি
🕐 ২:১৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৭, ২০২০
ছোট্ট পরিবার। বাবা, মা, ভাই আর আমাকে নিয়ে চার সদস্য বিশিষ্ট পরিবার। বাবা সরকারি অফিসের পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের অধীনে চাকরি করতেন। কাজের মূলমন্ত্র হিসেবে তাই বুঝি বাবা আমাদের পরিবারও ছোট রেখেছেন। কাজের সঙ্গে কথার মিল থাকা তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই কথা এখন আর কজন মানে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে মুচি পর্যন্ত। সবাই শুধু কথা দিয়েই যায়, রাখে আর না। থাকুক সেসব কথা। প্রকাশ্যে অপ্রিয় সত্যি বলাটা এখন একটু দৃষ্টিকটু। করতে মানা নেই বলতে মানা আর কি।
বাবার চাকরির বয়স শেষ হয়েছে। ভাই আমার থেকে দুই বছরের বড়। খুবই ভালো ছাত্র। যাকে বলে একদম বাঘা ছাত্র। আমার প?ড়াশোনা বুঝি গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত আসতই না যদি ও এত ভালো ছাত্র না হত। সর্বদা আমাকে সাহস জোগায়। প্রেরণা দেয় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। ভালো স্কুলে, কলেজে পড়ে ভাই এখন বড় ইঞ্জিনিয়ার। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে তড়িৎও ইলেকট্রনিক কৌশল বিষয়ের ওপর বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে। ভাই তখন মাত্র পড়াশোনার গ-ি পেরিয়ে চাকরি বাজারের প্রতিযোগিতায়। বতর্মানে এই বাজার যে কত গরম তা তো সবারই জানা।
বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলছিল। পরিবারের দিশেহারা অবস্থা। শিক্ষার এত উঁচু স্তরে উঠেও চাকরির ছিল না কোনো নিশ্চয়তা। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মার ঈশ্বরে অপ্রতুল ভক্তি। মানে ঈশ্বরে একান্ত বিশ্বাস যাকে বলে। একবার মাকে বলতে শুনেছিলাম ভাইকে যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রতি উত্তরে ভাই বলেছিল, ঈশ্বর তো শুধু আমার একার নয়।
বড়দের কথা। তখন কি আর এত মাথায় ঢোকে। তবে এখন বুঝতে পারি ভাই তখন কী বোঝাতে চেয়েছিল। কর্ম অনুযায়ী ঈশ্বর প্রত্যেককে তার ফল দিয়ে থাকেন এবং সবাইকে তার কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-গরিব সবার জন্যই ঈশ্বর এক। তিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের পার্থক্য করেন না। সৃষ্টির প্রত্যেকটি জিনিসকে তিনি ভালোবাসেন, যতœ করেন। তাদের কষ্টে কষ্ট পান আর আনন্দে হন খুশি। কারণ, ঈশ্বর তো কারো একার নয়।
আজ বিশ্ব করোনা ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে। পৃথিবীর প্রায় ২০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আমদানি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক উন্নত দেশেরও অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বিনোদন জগৎ থেকে শুরু করে খেলাধুলা সবকিছুই প্রায় বন্ধ রয়েছে। অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কারণে পুরো পৃথিবী আজ লকডাউন। প্রত্যেক মানুষ যেন নীলডাউন হয়ে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। সকল দেশের নাগরিকদের বলা হচ্ছে ঘরে থাকতে। মানুষ গৃহবন্দি। যারা থাকছেন না তাদের বাধ্য করা হচ্ছে ঘরে থাকতে। মানুষকে নিতে হচ্ছে খাঁচায় বন্দি প্রাণীর জীবনযাপনের স্বাদ।
নিজেদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমরা উজাড় করেছি অজস্র বন। অসংখ্য প্রাণীকে করেছি গৃহহীন। অনেক প্রাণীকে করেছি খাঁচায় বন্দি। সকল প্রাণীই মুক্তির স্বাদ চায়। যতই দানাপানি দেওয়া হোক মুক্তির স্বাদের কাছে সবকিছুই অর্থহীন। বিশ্বব্যাপী মানুষ এতদিন শুধু এই কথাগুলো পাঠ্যতে পড়েছে। নিজে উপলব্ধি করেনি।
সহস্র প্রাণীর সেই হাহাকার, কষ্ট, যন্ত্রণা, আপনজন হারানোর বেদনা বিশ্বকে এখন তা উপলব্ধি করতে হচ্ছে। মানুষ এই অল্প দিনে গৃহবন্দি থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। যে প্রাণীগুলোর জীবন শুরু এবং শেষ হয় খাঁচায় বন্দি থেকে তার কাছে এই কষ্ট তো অতি নগণ্য। কারণ ঈশ্বর তো কারো একার নয়।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা পানি চক্রের কথা তো ভালোই জানে। পানি কীভাবে আকাশ থেকে পড়ে মাটিতে মিশে এবং পুনরায় বাষ্পাকারে আকাশে চলে যায়। পৃথিবীর সব কিছুই এমন একটা চক্রে আবদ্ধ। নিজেদের প্রয়োজনে নষ্ট করেছি তাদের প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল, বৃদ্ধি করে চলেছি পৃথিবীর তাপমাত্রা, মনোরঞ্জনে প্রাণীকে বন্দি করেছি খাঁচায়, প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যবহার করে জীবনকে ঠেলে দিয়েছি নির্মম ঝুঁকিতে, শব্দ দূষণে জীবনকে করেছি অতিষ্ঠ। এই সকল কর্মের ফল তো পেতেই হবে।
ঈশ্বর হয়তবা এতদিনে বনের মোনাজাত কবুল করেছেন, আর নয়ত পাহাড়ের প্রার্থনা শুনেছেন অথবা সাগরের দাবিগুলোকে সঠিক বলে মনে করছেন। বর্তমানে প্রকৃতির যে রূপ গাছে গাছে ফুল, সাগরের বুকে ডলফিনের খেলা, কচ্ছপের অবাধ বিচরণ, পাখির কলরব, দূষণমুক্ত নির্মল বাতাস, সাগরের তীরে ফুটে ওঠা সাগরকন্যা এগুলো তো তাই প্রকাশ করে।
আঁখি রানী দাস তিতলি : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]