ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কোমল পানীয়তে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা

শেখ আনোয়ার
🕐 ১০:২২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০

কোথাও বেড়াতে কিংবা পার্টিতে গেলে যেন কোমল পানীয় ছাড়া চলেই না। কি বন্ধুর আড্ডা, পার্টি, পিকনিক সবখানে কোমল পানীয়ের ছড়াছড়ি। শিশুদের অনুষ্ঠানগুলো তো এছাড়া ভাবাই যায় না। গরম খাবারে একটু তৃষ্ণা মেটাতে চাই এক চুমুক কুল ঠাণ্ডা পানীয়। আর আজকাল কোম্পানিগুলোও বিভিন্ন রঙে, ঢঙে তৈরি করছে বিভিন্ন পানীয়।

আবার দেখা যায়, কাঁচামাল একই শুধু একটু রঙ অথবা ফ্লেভার পাল্টিয়ে অন্য নামে মার্কেটে ছেড়ে দিচ্ছে একই পণ্য। এ যেন নতুন বোতলে পুরনো শরবত। তারপরও বিশ্বজুড়ে আজ কোমল পানীয়ের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। দিনে দিনে ব্যাপকতা লাভ করছে।

জুস জাতীয় কোমল পানীয়ের উৎপাদন ও ব্যবহার অনেক পূর্বে শুরু হলেও আজ অবধি এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণার পরিমাণ খুবই কম। কিন্তু গত এক দশক থেকে এর ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পুষ্টি বিজ্ঞানী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য সংস্থার টনক নড়েছে। পরীক্ষায় দেখা যায়, ৫০০ গ্রামের কৌটাগুলোতে কার্বন, ১৭০ ক্যালরি সোডা এবং ১৫ চা চামচ চিনি ব্যবহার করে থাকে। যা শিশুর শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, দিনে ১/২টা কোমল পানীয় গ্রহণ করার ফলে নিম্নোক্ত রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। তা হলো বিষণ্নতা, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, দাঁতের ক্ষয়রোগ। ইনসুলিনের আবিষ্কারক ডা. চার্লস বেস্ট-এর মতে, ‘যে সকল লোক অত্যধিক কোমল পানীয় গ্রহণ করে থাকে তাদেরও লিভার সিরোসিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাদের সমপরিমাণ যারা দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণ করে থাকে। আর সিরোসিসের একমাত্র চিকিৎসা হল ‘লিভার ট্রান্সপ্লান্ট’।

এছাড়া আধুনিক বিভিন্ন কোম্পানির পানীয়ের মধ্যে যে সকল উপাদান থাকে সেগুলো এবং তাদের প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ যেমন এসিডের মাত্রাতিরিক্ততা। কোমল পানীয়ে অধিক মাত্রায় থাকে। যা পরিপাকতন্ত্রের খাদ্য হজমে বাধা সৃষ্টি করে। ফসফরাসের অভাব। অতিরিক্ত ফসফরাস স্টোমাকের হাইড্রলিক এসিডের সঙ্গে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে ও পেট ফাঁপা ভাব সৃষ্টি করে। ক্যাফেইনের অত্যধিকতা। কোমল পানিতে ক্যাফেইন ব্যবহারের ফলে তা গ্রহণকারীর উদ্বিগ্নতা, নার্ভাসনেস এবং সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা দেখা দেয়। শরীরে অক্সিজেনের হ্রাস পাওয়া।

ডা. ফ্রান্সিসকো কন্টারাইজ নামক আমেরিকার একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বলেন, ক্যান্সার হলো একটি বৃক্ষের ন্যায় আর অক্সিজেনবিহীন টিস্যু সেল হলো এর পৃষ্ঠপোষক। তাই অত্যধিক কোমল পানীয় গ্রহণের ফলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। যার ফলে ক্যান্সারের আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। দাঁতের ক্ষয়রোগ সৃষ্টিতে: কোমল পানীয় দাঁতের ক্ষয় রোগ সৃষ্টি করে। মাড়িকে দুর্বল করে তোলে। এর প্রভাবে ডেন্টাল ক্যারিজ বা দাঁত ক্ষয় রোগ দেখা দেয়।

এছাড়া পেপসি, কোকাকোলা, আরসিকোলা, ইউরোকোলা, সেভেন আপ, স্প্রাইট, ফিজআপ, আপারটেন, সানক্রেস্ট ইত্যাদি ব্রান্ডের কোমল ড্রিংকসও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা গেছে এসব কোমল পানীয়তে কোনো পুষ্টি উপাদান তো নেই-ই বরং দেহের জন্য ক্ষতিকর কিছু রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। আমেরিকা, মালয়েশিয়া, জাম্বিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেশকিছু দেশের গবেষণার রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিয়মিত কোমল পানীয় খাওয়াতে দাঁতের, হাড়ে, পেশির, লিভারের জটিল রোগ হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশু-কিশোরদের।

কোমল পানীয়ের অন্যতম উপাদান হচ্ছে ক্যাফেইন। ক্যাফেইন একটি আসক্তিকর মাদক, যা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। এটি দেহকে কৃত্রিমভাবে উত্তেজিত করে। হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে, সাময়িক বুদ্ধিবৃত্তি বাড়ায় এবং অবসন্ন ভাব বা শ্রান্তি দূর করে।

অত্যধিক ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে বর্ধিত হারে মূত্রাশয় ও পাকস্থলির ক্যান্সার এবং উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এটি শিশুদের মধ্যে জন্ম বৈকল্য সৃষ্টি করে। ডায়াবেটিসের কারণ এবং পাকস্থলীর দেয়ালের ক্ষতি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শারীরিক কঠোর পরিশ্রমের পর কোমল পানীয় পান করলে ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাব ঘটতে পারে।

গবেষকরা বলেন, অধিকাংশ কোলা পানীয় ফসফরাস, ক্যালসিয়াম এবং হাড়ের ক্ষতিকে দ্রুত করে দেয়। কৃত্রিম মিষ্টিকারক হিসেবে কোমল পানীয়তে এসপারটেম, এসিসালফেম ও স্যাকারিন ব্যবহার করা হয়। এগুলো স্মৃতি বিনষ্ট, মৃগীর খিচুনি, বমিভাব, ডায়রিয়া, অস্পষ্ট দৃষ্টি, মস্তিষ্কের ক্যান্সার, মূত্রাশয়ের ক্যান্সার সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এসব গ্রহণে লিভার সিরোসিসের মতো জটিল রোগ হতে পারে।

কোমল পানীয়কে সজীবতা ও অম্ল স্বাদ আনয়নের জন্য সাইট্রিক এসিড, ফসফরিক এসিড এবং কদাচিৎ মেলিক এসিড ও টারটারিক এসিড ব্যবহার করা হয়। ব্রিটিশ পুষ্টি সংস্থার মতে, অতি মিষ্ট পানীয় অথবা অম্ল স্বাদযুক্ত পানীয় পান করার পর দাঁত পরিষ্কার করলেও দাঁতের ক্ষতি হয়।

ব্রিটেনে এক জরিপে দেখা গেছে, যারা নিয়মিত কোমল পানীয় পান করে তাদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ দাঁতের রোগে ভোগে। একটি দাঁত কোমল পানীয়তে দুদিন রেখে দিলে দাঁতটি নরম হয়ে যায়। ফসফরিক এসিডের ফসফরাস মানুষের পাকস্থলীর হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বদহজম, গ্যাস এবং পাকস্থলী স্ফীতির সৃষ্টি করে।

অধিক চাপের কার্বন-ডাই-অক্সাইড কোমল পানীয়তে বুদবুদ সৃষ্টি করে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড একটি বিষাক্ত দূষিত পদার্থ। বাতাসে এর পরিমাণ বাড়লে বাতাস দূষিত হয়। অথচ এ দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমরা কোমল পানীয়ের সঙ্গে খাচ্ছি। ফলে ফুসফুসের জটিল রোগ হওয়ার আশঙ্কা আছে। কোমল পানীয় মূল উপাদান ৯৯% ডিসটিলড ওয়াটার।

সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যতো বেশি ডিসটিলড ওয়াটার পান করবে তার মধ্যে ততো খনিজ পদার্থের স্বল্পতা ও এসিড অবস্থার সৃষ্টি হবে। এছাড়া কোমল পানীয়ের সংরক্ষণ মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য কার্বনিক এসিড বেনজয়িক এসিড বা সোডিয়াম বেনজয়েট দেওয়া হয়। এগুলো হাঁপানি, ফুসকুড়ি এবং অতি সক্রিয়তার কারণ ঘটায়।

পরিষ্কার করতে যে সালফার ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা হয় তা কোমল পানীয়তে সংরক্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা রক্তিমাভা, মূর্ছাভাব, ত্বক স্ফীতি, মাংসপেশী ফোলা, দুর্বলতা, বুকে টান টানভাব এর কারণ ঘটায় এবং হাঁপানি রোগীর হাঁপানি বেড়ে যায়।

রঙিন কোমল পানীয় বেশি ক্ষতিকর। কারণ, ব্যবহৃত কৃত্রিম রঙ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। পেপসির টারট্রাজিনের রঙ কমলা-হলুদ। এই রঙ এলার্জিক বিক্রিয়া সৃষ্টি করে বিধায় নরওয়ে ও সুইডেনে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি ক্যান্সার সৃষ্টিকারক এজেন্ট। মিরিন্ডা অরেঞ্জে সানসেট ইয়েলো এবং টারট্রাজিন দেওয়া হয়। এটিও ক্যান্সার সৃষ্টিকারক। এটিও উক্ত দেশ ও ফিনল্যান্ডে নিষিদ্ধ করেছে।

উল্লেখ্য, অন্য রঙও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। গবেষকরা জানিয়েছেন, কোমল পানীয়কে ঠাণ্ডা রাখার জন্য ইথাইলিন গ্লাইকোল দেওয়া হয়। এই রাসায়নিক পদার্থ আর্সেনিকের মতোই ধীরঘাতক। এক ঘণ্টার মধ্যে কেউ ৪ লিটার কোমল পানীয় খেলে মৃত্যুবরণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

আজকাল রাস্তাঘাটে ফুটপাতে ফেরি করেও ঠাণ্ডা কোমল পানীয়, জুস ও আইসক্রীম চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। অনেক সময় সপরিবারে বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে গেলে প্রিয় সন্তানের চাপাচাপিতে শিশুকে একটি কোমল পানীয় কিনে দিচ্ছেন মাতা-পিতা। কিন্তু এর সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছেন একটি নীরব ঘাতক ব্যাধির আশঙ্কা।

তাই এখন থেকে কোমল পানীয় গ্রহণে সবাইকে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনে পানিশূন্যতার জন্য নেওয়া যেতে পারে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির গ্লুকোজ যুক্ত স্যালাইন। যা শরীরের লবণ-পানি হ্রাসের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। ফিরিয়ে দেয় প্রাণচাঞ্চল্য।

শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
[email protected]

 
Electronic Paper