ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

২০ বছরেও হলো না ‘মধুপল্লী’

সামসুজ্জামান
🕐 ৯:৫০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯

বাংলা অমৃতাক্ষর ছন্দের (সনেট) প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান যশোর জেলার কেশবপুর থানার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। পিতা জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত এবং মা জাহুবীদেবীর অতি আদরের সন্তান মধুসূদনের জন্ম ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু সবারই জানা, জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।

তার জীবন যতটা না বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি ছিল যাতনায় পূর্ণ। সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্ম নিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সেই মধুকেই জীবনের নানা বাঁকে এসে পড়তে হয়েছে নিদারুণ অভাব ও অর্থকষ্টে। যে দেশ আর ভাষাকে তিনি ‘হেয়’ করে দেখেছেন ‘ বৈশ্বিক’ হওয়ার তাড়না থেকে, শেষাবধি সেই তিনিই বলেছেন,

‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।’
তিনি ইংরেজি শিক্ষার প্রতি ছিলেন খুব বেশি আকৃষ্ট। তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। কিন্তু বাধ সাধেন তার পিতা রাজনারায়ণ দত্ত। এ কারণেই তিনি নিজ জন্মভূমি ছেড়ে চলে যান কলকাতায়। সেখানে তিনি ইংরেজি শিক্ষার জন্য একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখাপড়ার হাতেখড়ি মৌলভী লুৎফর রহমানের কাছে। তিনি ছিলেন সাগরদাঁড়ি শেখপাড়া গ্রামের মসজিদের ইমাম। তিনি ছিলেন ফার্সি ভাষায় দক্ষ। মাইকেল মধুসূদন তাঁর কাছ থেকে ফার্সি এবং আরবি শিখতেন। মৌলভী লুৎফর রহমান ছিলেন তার শিক্ষাগুরু।

তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হেনরিয়েটাকে বিয়ে করে পিতার চক্ষুশূল হয়ে যান। হেনরিয়েটাকে কলকাতা থেকে বজরায় করে নিয়ে আসেন সাগরদাঁড়িতে। কিন্তু পিতা রাজনারায়ণ দত্ত পুত্র এবং পুত্রবধূকে বাড়িতে উঠানো তো দূরের কথা পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ পর্যন্ত নিতে দেননি। বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে ঢুকতে দেননি বাড়িতে।

সাত দিন বজরায় অবস্থান করে অবশেষে মাইকেল কলকাতায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। তাঁর মনেও জেদ চেপে যায়। আমৃত্যু তিনি আর জন্মভূমিতে ফেরেননি। কলকাতা, মাদ্রাজ, জার্মানি, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর মত্ত থেকেছেন কাব্যচর্চা নিয়ে। বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন তিনি। কোনো এক অদ্ভুত খেয়ালে তিনি চৌদ্দ অক্ষরের অমৃতক্ষর ছন্দের প্রবর্তক হয়ে যান। তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর এই চর্চা। তিনি ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য লিখে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

কেশবপুর উপজেলা সদর থেকে সাগরদাঁড়ির দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। পিচের রাস্তা কিন্তু বন্ধুর পথ। যেহেতু কবির পিতা জমিদার ছিলেন। তাই তাঁর ছিল অগাধ সম্পত্তি। কালের আবর্তে এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই ভূ-সম্পত্তি এখন বেহাত হয়ে গেছে। যে যেভাবে পেরেছে দখল করেছে। তারপর এখনো অনেক সম্পত্তি রয়েছে।

’৬৫ সালে পাক-সরকার কবি ভক্তদের থাকার জন্য চারশয্যা বিশিষ্ট একটি রেস্টহাউস বানিয়েছিল। এই রেস্ট হাউসেরই একটি রুমে পাঠাগার বানানো হয়। ’৮৫ সালে কবির বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে সরকার ন্যস্ত করে। কবির জন্মস্থান-খ্যাত ঘরটি এখন আর নেই। একটি তুলসীগাছ লাগিয়ে কেবল চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। কবির মূলবাড়ি সংলগ্ন আম বাগানে অবস্থিত আবক্ষ মূর্তিটি কলকাতার সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক স্থাপন করে দেয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জমিদারবাড়ির অসংখ্য ঘরের পলেস্তারা নতুন করে করেছে। একটি ঘরে কবির ব্যবহৃত অনেক কিছুই ঠাঁই পেয়েছে। ’৮৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাড়ির পুকুরসহ পুরো এলাকাটি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।

কথিত বাদামগাছ, যার নীচে বসে কবি কবিতা লিখতেন তাঁর বাঁধানো গোড়াটি এখন ফাটল ধরে নদীভাঙনে ভেঙে পড়ছে। যে বজরায় কপোতাক্ষ নদীতে কবি সস্ত্রীক অবস্থান করেছিলেন সাত দিন। সেখানে একটি পাথরের খোদাই করে লেখা আছে ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে’। কবিতা সংবলিত এই জায়গাটি ‘বিদায় ঘাট’ নামে খ্যাত।

কবির জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য কবিভক্ত এখানে আসে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো থাকা এবং খাওয়া। কোনো আবাসিক হোটেল নেই থাকার জন্য, নেই কোনো মানসম্মত খাবার হোটেল। তাই তো কবি ভক্তদের বেলা থাকতেই ফিরে আসতে হয়। কবি মধুসূদনের জন্মস্থান সাগরদাঁড়ি ঘিরে রয়েছে অনেক স্মৃতি অনেক বেদনার কাহিনী। কিন্তু পর্যটকদের দেখার সুযোগ নেই। ’৯৯ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কবির জন্মদিনে মধুমেলার উদ্বোধন করেন এবং সাগরদাঁড়িকে ‘মধুপল্লী’ হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু দীর্ঘ দু-দশকেও এর কোনো কার্যক্রম এখনো শুরুই হয়নি।

সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন একাডেমি নামে একটি পাঠাগার রয়েছে। যেখানে মাইকেলের পিতা-পিতামহের আমলের অনেক দুর্লভ ছবি এবং অনেক চিঠিপত্র সংরক্ষিত আছে। এই পাঠাগারটি পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে। স্বাধীনতার পর এখানে মাইকেল মধুসূদন একাডেমি এবং সাগরদাঁড়ি কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুসজ্জিত মঞ্চ এবং অডিটোরিয়াম নির্মিত হয়েছে। কবির বাড়িসংলগ্ন আমবাগানটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। গাছগুলো দেখলে মনে হয় কয়েকশ বছরের পুরনো। এখনো গাছগুলোতে আমের ফলন হয়ে থাকে।

প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য লোক সাগরদাঁড়িতে পিকনিক করতে আসে। এ ছাড়া শিক্ষা সফরে আসে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু এখানে কোনো পিকনিক স্পট ও বিশ্রামাগার না থাকায় তাদের পোহাতে হয় ঝামেলা। নদীর পাড়ে বাগানে যত্রতত্র রান্না করে সেখানেই খাওয়া-দাওয়ার কাজ সারতে হয়। এ বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। একটি পিকনিক স্পট এবং পিকনিক পার্টির জন্য বিশ্রামাগার আবশ্যক।

কপোতাক্ষের বিস্তীর্ণ তটরেখা তালা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। তাই তো জোয়ারের সময় এখনো নদীতে বান ডাকে। যদি এই তটরেখায় আবাসিক হোটেল গড়ে তুলে সুন্দর করা যায়, তাহলে পর্যটকের আকর্ষণ আরও বাড়বে। কবির জন্ম-মৃত্যুর অনুষ্ঠান ছাড়াও সারা বছরই সাগরদাঁড়িতে ভিড় লেগে থাকে।

দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা থাকে বারো মাসই। কিন্তু কেবল থাকা এবং খাবার সুব্যবস্থা না থাকায় ভক্তদের আকাক্সক্ষা পূরণ হয় না। কবির অনেক আত্মীয়স্বজনও প্রতি বছর ভারত থেকে এখানে এসে থাকেন। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই তাদের ফিরে যেতে হয় জেলা শহরের কোনো হোটেলে।
এখানে কবির দুর্লভ জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে একটি জাদুঘর তৈরির সম্ভবনা রয়েছে। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের।

এককালের খরস্রোতা কপোতাক্ষকালের আবর্তে আজ সংকীর্ণ হয়ে গেলেও এখনো বিলীন হয়নি। কবির বাড়িকে ঘিরে তাই সাগরদাঁড়িকে এখনো পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এর ফলে একদিকে সরকার যেমন লাভবান হবেন তেমনই বাংলাসাহিত্যে সনেটের প্রবর্তক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আরও বিশ্বখ্যাত হয়ে উঠবেন নিঃসন্দেহে। সৃষ্টি হবে নতুন এক পর্যটন নগরী।

সামসুজ্জামান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

 
Electronic Paper