ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কুসংস্কার দেশে-দেশে

জিয়াউল হক কামাল
🕐 ৯:০৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১১, ২০১৯

সকালে বাসা থেকে বেরোনোর সময় চুল আঁচড়াতে গিয়ে হাত থেকে হঠাৎ চিরু–নিটা পড়ে গেল। তাই দেখে আমার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েটি বলে উঠল, মা-মা আজকে আমাদের বাসায় কেউ বেড়াতে আসবে। আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ তোমার এরকম মনে হলো কেন? মেয়ে বলল, কেন, সেদিন যে টিভিতে দেখলাম- চুল আঁচড়াতে গিয়ে হাত থেকে হঠাৎ চিড়ুনি পড়ে যাওয়া নাকি বাড়িতে মেহমান আসার লক্ষণ, তাই আমি বললাম।

দৈনন্দিন জীবনের কোনো ঘটনাকে ভবিষ্যৎ মঙ্গলের সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করাই হলো কুসংস্কার। এটি এমন এক বিশ্বাস, যা মানুষ আবহমানকাল ধরে বংশপরম্পরায় মেনে আসছে। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিভিন্ন সংস্কার/আচরণের মাধ্যমে এগুলো লক্ষণ অনুযায়ী প্রতিপালন করে আসছে। এগুলোর প্রাপ্ত ইতিহাস, ব্যপ্তি ও বিস্তৃতি কখনো অবাক হওয়ার মতো।

একেকটি আচরণের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, ভীতি মানুষের সহজাত। যার কোনো সুনির্দিষ্ট উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মানুষ মাত্রই তা মেনে থাকে। মানতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে এলাকাবিশেষে ও সেই এলাকার সংস্কৃতিবিশেষে। আমাদের দেশে তো বটেই, এমনকি আমরা যাদের উন্নত দেশ/জাতি হিসেবে জানি এবং মানি তাদের আচরণও এর ঊর্ধ্বে নয়। যদিও হাস্যকর, ভিত্তিহীন এবং শুধুই জনশ্রুতিনির্ভর। কিন্তু অন্তরে লালিত সংস্কার থেকেই তা শ্রদ্ধা, বিশ্বাসের সঙ্গে মেনে থাকে এমন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে বিশ্বজুড়ে।

যেমন: বছরের প্রথম দিন ভালোভাবে অতিবাহিত হলে বছরের অন্যান্য দিনও ভালোভাবে যাবে- এই বিশ্বাসে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এই দিনটিতে ভালো পোশাক, ভালো খাবারের প্রথা বিরাজমান বহুকাল ধরে।

পোষা বিড়ালকে তার গা বা পা চেটে পরিষ্কার করতে দেখা গেলে বাড়িতে মেহমান আসার ইঙ্গিত বলে ধরা হয়ে থাকে।
পোষা কুকুর যদি বাড়ির আঙিনায় অস্বাভাবিক শব্দে ডাকে তবে তা বিপদ বা কোনো ক্ষতির আশঙ্কা হিসেবে মনে করা হয়।
যদি ডান হাতের তলা চুলকায় তাহলে অর্থ প্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনা বলে আশা করা হয়।

যদি খেতে বসে কেউ বিষম খায় তবে ধরে নেওয়া হয় তাকে নিয়ে অন্য কোথাও আলোচনা হচ্ছে বা কেউ তাকে স্মরণ করছে।
যখন কোনোখানে কারও সম্পর্কে কথা চলে, যাকে নিয়ে কথা চলছে সে ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হলে তার আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেল বলে মনে করা হয় এবং সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।

যদি ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা হয়, তবে তা অমঙ্গলের প্রতীক বলে বিবেচনা করা হয়।
পরনে থাকা অবস্থায় কাপড় রিপু করা বা ছুটে যাওয়া বোতাম লাগানো অমঙ্গলের লক্ষণ বলে গণ্য হয়।
খাওয়ার পর কেউ যদি গোসল করে তবে তা অশুভ, যা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয়।
হাত থেকে কোনো জিনিস পড়ে গেলে যার হাত থেকে পড়ে গেল তার বিপদের সম্ভাবনা বলে ধরে নেওয়া হয়।
রাতের বেলা টাকা ধার দেওয়া হলে তা অশুভ পরিণতি বয়ে আনতে পারে বলে ধরা হয়।

এ আমাদের সমাজে সাধারণ কিছু কুসংস্কারের বহুল প্রচলিত উদাহরণ। শুধু এদেশে নয়, অনেক দেশেই এমন অনেক কুসংস্কার আছে। যেমন:
কোরিয়ায় কাক দেখলে তা অশুভ/মন্দ কপালের পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। কাক যুক্তরাজ্যেও অশুভ লক্ষণ। আবার লন্ডন টাওয়ারে সবসময় ছয়টি কাক দেখা না গেলে তা রাজতন্ত্রের পতনের লক্ষণ বলে মনে করা হয়।

আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে একটি দোয়েল দেখা গেলে তা অশুভ; কিন্তু দুই বা তার অধিক দেখা গেলে তা মঙ্গলজনক হিসেবে ধরা হয়।
চলার পথে কালো বিড়াল দেখলে তা অশুভ লক্ষণ/সম্ভাব্য দুর্দশার প্রতীক বলে মনে করা হয়।
ফ্রান্সে সকাল বেলায় মাকড়সা দেখা গেলে তা দুঃখের প্রতীক বলে ধরা হয়।

রাশিয়া, হাঙ্গেরী ও অনেক দেশ আছে যেখানে খাবার টেবিলের কোনায়/প্রান্তে আসন গ্রহণ করা হলে তা ৭ বছরব্যাপী বিয়ে না হওয়ার মতো অশুভ বলে ধরা হয়। তাহলে জেনে বুঝে এই ঝুঁকি কে নেবে?
তুরস্ক, কোরিয়া এবং ভারতে সূর্যাস্তের পর হাত-পায়ের নখ কাটাকে অশুভ কাজের পর্যায়ে ফেলা হয়। জাপানি কুসংস্কারের মতে এটা এমনকি অকাল মৃত্যুও বয়ে আনতে পারে।
‘ফুটপাতের চিড় খাওয়া অংশের ওপর দিয়ে হেঁটো না- এটা দুর্ভাগ্যের কারণ’- জর্জ ওয়াশিংটন।

এখন আসা যাক গাণিতিক সংখ্যার অশুভতে। বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত অশুভ সংখ্যা ধরা হয় ‘১৩’ (তেরো) কে। অনুসন্ধানকারীদের হিসেবে দেখা গেছে, শতকরা ১০ জন আমেরিকানের মধ্যে ‘১৩’ সংখ্যাটিকে নিয়ে একটি ভীতি প্রচলিত আছে এবং বছরের ‘১৩’ তারিখ বিশিষ্ট শুক্রবারটি নিয়ে তা আরও বেশি, যা একটি ‘ফোবিয়া’ বলে পরিচিত। ফলশ্রুতিতে ওই বিশেষ দিনে কাজে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া এমনকি বিয়ে করতে যেতেও আপত্তি- যেন নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। যার কারণে বছরে ৮শ’ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয় বলে জানা যায়।

আমেরিকার অ্যাসভিলি, নর্থ ক্যারোলাইনার ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের ‘ফোবিয়া ইনস্টিটিউটের’ মতে সেখানে শতকরা ৮০ ভাগ হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে ‘১৩’তম তলাটি অনুপস্থিত এবং অধিকাংশ হোটেল, হাসপাতাল ও বিমানবন্দরের কক্ষ ও প্রবেশদ্বারগুলোতে এই সংখ্যাটি এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কী এমন অশুভ ব্যাপার আছে এই সংখ্যাটিতে এবং কীভাবেই বা এই গাণিতিক সংখ্যার ‘অশুভ’ হিসেবে যাত্রা শুরু?
প্রাচীন লোককথা যা এই ভীতিকে ঘিরে আবর্তিত হয় তার মূলে রয়েছে উদ্ধারকৃত বেবিলনীয় রাজা হাম্বুরাবি কর্তৃক প্রণীত পৃথিবীর প্রথম আইনের প্রমাণপত্র ‘দি কোড অব হাম্বুরাবি’-তে ‘১৩’তম বিধির অনুপস্থিতি। যদিও এই বিধিটির অনুপস্থিতি পরবর্তীকালে অনুবাদকারীর অসাবধানতাবশতঃ একটি বাক্যাংশ/লাইনের অনুল্লেখ বইতো আর কিছু নয়- কেননা, আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে ‘দি কোড অব হাম্বুরাবি’ লিখনকালে ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ করার গাণিতিক জ্ঞান অনাবিষ্কৃত ছিল বলেই ধারণা করা হয়।

তাই ত্রুটিহীন একটি ‘শুভ’ সংখ্যার সন্ধানে ‘১৩’ সংখ্যাটির অনাকাক্সিক্ষত অনুপস্থিতি যেন প্রথাসিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। ‘অশুভ’ সংখ্যার সংজ্ঞা নির্ধারণে একটি অজানা আশংকা প্রচলিত দুটি ধারণার ওপর আবর্তিত বলে অনুমিত হয়- যা বাইবেলে বর্ণিত প্রাচীন ঘটনা সম্পৃক্ত; ঘটনা মতে- মৃত বীরযোদ্ধাদের সমাধি ভবনে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় যিশু ও তার শিষ্যদের একত্রে শেষ আহার (দি লাস্ট সাপার) অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ১২ জন শিষ্যের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক ‘জিহুদা ঈস্করিয়’ এর ‘১৩’তম সদস্য হিসেবে হঠাৎ অনুপ্রবেশ।
কথিত আছে যে, উৎকোচের বিনিময়ে ঈস্করিয় ক্রুশবিদ্ধকারীদের আত্মগোপনে থাকা যিশুর অবস্থান জানিয়ে দেয়।

সমসাময়িককালে নরওয়ের লোককথা থেকে জানা যায় যে, দুনিয়াতে অশুভ ও অশান্তির যাত্রা সেদিন থেকে শুরু হয় যেদিন মর্যাদাপূর্ণ ভোজন স্থলে যিশুর প্রতি বিশ্বাসঘাতক, ক্ষতিকর, দুষ্ট দেবতা ‘লোকী’ ১২ জন উপস্থিত দেবতার মধ্যে ‘১৩’তম হিসেবে উপস্থিত হয়ে ১২ সংখ্যার ভারসাম্য বিনষ্ট করেছিল।

ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের দ্বারা ‘১২’ সংখ্যাটির উৎকৃষ্টতা স্বীকৃত হওয়ায় সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত সংখ্যাতত্ত্বে ‘১২’ সংখ্যাটির ব্যবহার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হয়- যা বিশ্বব্যাপী আজও সময় পরিমাপে ব্যবহৃত হয়; প্রায় সব ক্যালেন্ডার ১২ মাস বিশিষ্ট; একটি দিন ‘১২’ ঘণ্টার সমান দুটি অংশে বিভক্ত। অশুভ ধারণা প্রসূত ‘১৩’ সংখ্যাটি পশ্চিমাদের একেবারেই মনগড়া বিশ্বাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। কেননা, খোদ আমেরিকার জাতীয় পতাকাতেই ‘১৩’টি স্ট্রাইপ এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রীয় সীলমোহরে ‘১৩’টি তারকা চিহ্ন আছে।

কিছু সভ্যতা- বিশেষত প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় ‘১৩’ সংখ্যাটিকে অশুভ হিসেবে না দেখে সেখানে সাধারণভাবে সংখ্যাটি পাল্টে ০৪ (চার) সংখ্যাটিকে অশুভ হিসেবে ভাবতে শুরু করা হয়, যা এশিয়ার অনেক অঞ্চলেই প্রচলিত। জাপানে ০৪ (চার) উপাদানবিশিষ্ট উপহার প্রদান এড়িয়ে যাওয়া হয়- যেমন ০৪ (চারটি) ফুল বা যে কোনো ০৪টি (চারটি) সামগ্রীর সমন্বয়ে সাজানো একটি উপহার প্যাক; এমনকি অ্যাপার্টমেন্ট, বিল্ডিং-এর ০৪ (চার) তলা, ফ্ল্যাট নম্বর বা যে কোনো কিছুতেই ০৪ (চার) সংখ্যাটি এড়িয়ে চলা হয়।

প্রথাগতভাবে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে ০৪ (চার) সংখ্যার ব্যবহার রীতিমতো বিরল- আর এই সংখ্যার ব্যবহার চীনসহ সমগোত্রীয় ভাষাভাষীর দেশেও সমহারে উপেক্ষিত- কেননা ০৪ (চার) সংখ্যাটির চীনা/সমগোত্রীয় ভাষায় উচ্চারণ ‘মৃত্যু’ শব্দের সমার্থক অর্থাৎ অশুভ।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে প্রচারিত টিভি চ্যানেলের অসংখ্য অনুষ্ঠানে কুসংস্কারের যেন চাষ করা হচ্ছে। যা টিভি খুলে দেখে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। ক্রমান্বয়ে আমরাও এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি- এমনকি কখনো বা অজান্তে মেনেও নিচ্ছি, যা আমাদের কালচারে স্থায়ী অনুপ্রবেশ করছে বলাই বাহুল্য।

জিয়াউল হক কামাল : সাবেক ব্যাংকার

 
Electronic Paper