ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী-৫৬

নদী হারাচ্ছে পরিচিতি

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯

বাংলাদেশের অনেক নদী এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। নদীর সংখ্যা কমছে। অনেকে নদী বিলুপ্ত নদীর তালিকাভুক্ত হওয়ার পথে। এ ছাড়াও নদীর চেহারা বদলে দিয়েও নদীর ‘নদী’ পরিচিতি বদলে দিয়ে ‘খাল’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। এই সংখ্যা কম নয়। নদী যখন পুনঃখনন করা হয়, তখন নদীর দুপাড়ে এমনভাবে মাটি ফেলা হয় যে, দেখতে অনেকটাই খালের আকৃতি ধারণ করে। বিশেষত যেসব ছোট নদী খনন করা হয় সেগুলোর প্রবাহ পথ অনেক সরু আকৃতি লাভ করে। তখন অনেকেই এমন নদীকে খাল নামে ডাকতে থাকে। নতুন প্রজন্ম ছোট থেকে এরকম নদীকে খাল নামে ডাকতেই অভ্যস্ত হয়। ধীরে ধীরে এসব নদী খাল হিসেবে পরিচিতি পায়।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এমন নদী কেটে থাকে। অনেক নদী আছে যেগুলো স্থানীয়ভাবে নদী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বিএডিসি কিংবা বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এগুলোকে কাগজে কিংবা সাইনবোর্ডে খাল হিসেবে উল্লেখ করছে। এরকম অনেক নদীর খবর আমি জানি।

সরেজমিন নদীর কাজ করতে গিয়ে আমি এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলায় দেউলা নামক একটি স্থান আছে। সেখানে একটি বড় নদী ছিল। নদীটির নাম দেউল নদী। কেউ কেউ এটাকে কালিদা সাগরও বলত। অর্ধশত বছর আগে এর স্বাস্থ্যবান রূপ ছিল। বর্তমানে এই নদীটি দেখতে যেমন খালের মতো লোকমুখে এর পরিচিতিও খাল হিসেবে।

নীলফামারীর জেলার সৈয়দপুরের কাছেই কামারপুকুর নামে একটি স্থান আছে। সেখানে বাগডোকরা নামে একটি নদী আছে। এ নদীর ওপর দিয়ে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক। স্থানীয় জনগণ এখনো বাগডোকরাকে নদী হিসেবেই ডাকে। কিন্তু সরকারিভাবে ওই নদীর পাড়ে বাকডোকরা খাল হিসেবে সাইনবোর্ড ঝুলানো হয়েছে। নতুন প্রজন্ম যখন দেখবে নদীটি দেখতে খালের মতো, সরকারিভাবে খাল হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে তখন তারাও এটাকে খাল হিসেবেই ডাকতে থাকবে। দূর ভবিষ্যতে হলেও এটি একদিন খাল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। এই নদীতে আগে সারা বছর পানি থাকত। প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। নদীটি নীলফামারী সদর উপজেলার একটি নিম্নাঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে সৈয়দপুর পৌরসভার পূর্বদিকে চিকলি নদীতে মিলিত হয়েছে।

নীলফামারী জেলাতেই আকেটি নদীর নাম নেংটি ছেঁড়া। নদীটি এখন সরকারিভাবে খাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে কমেছে এ নদীর প্রবাহ এবং আকৃতি। ক্ষীণ আকৃতির এ নদীটিকে কেটে খালের রূপ দেওয়া হয়েছে। অথচ স্থানীয়ভাবে এ নদীটি সম্পর্কে বলা হয়- নদীটি প্রবল বেগে প্রবাহিত হতো। স্রোতের বেগ এতটাই থাকত যে, কেউ নেংটি পরে নদীতে নামলে নেংটি ছিঁড়ে যেত। সে জন্য এ নদীর নামই নাকি হয়েছে নেংটি ছেঁড়া।

রংপুরের মিঠাপুকুর-পীরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদী ছিল আখিরা। এই আখিরাকে এখন খাল বলা হয়। রংপুর শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শ্যামাসুন্দরী নদী। জমিদার জানকী বল্লভ সেন এ নদীটি পুনরায় খনন করেন। তারপর থেকে এর পরিচিতি ধীরে ধীরে খাল হিসেবে হয়েছে। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার একটি নদীর নাম খটখটিয়া। এই নদীকে খাল হিসেবে উল্লেখ করে বিএডিসি খনন করছে। অথচ পুরনো জমির নকশায় এটাকে নদী হিসেবে উল্লেখ করা আছে।

নদীকে খাল হিসেবে উল্লেখ করার মধ্যে কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভ আছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নদী খননের অনুমোদন নেই কিন্তু খাল খননের অনুমোদন আছে তারা চায় নদীকে খাল বানাতে। নদীকে প্রকল্পে খাল হিসেবে উল্লেখ করা গেলে সেসব প্রতিষ্ঠান খননের অনুমোদন পেতে পারে। এ কারণেও অনেক ছোট নদীকে দ্রুতই খাল হিসেবে নাম দেওয়া গেছে।

কোনো কোনো এলাকায় ‘নদী’ অস্তিত্ব হারিয়ে হয়েছে বিল। কুড়িগ্রাম জেলা থেকে নাগেশ্বরীর যাওয়ার পথে মধ্যকুমরপুর নামক স্থানে পাঁচগছির ছরা নামক একটি নদী আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ নদীটি ধরলার আন্তঃশাখা নদী ছিল। আন্তঃশাখা বলতে ধরলার শাখা নদী, আবার ধরলারই উপনদী। মধ্য কুমরপুরের কাছেই নদীটি ধরলা থেকে উৎপন্ন হয়ে আবার ধরলায় মিলিত হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এ নদীর ওপর সেতু ছাড়াই আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করা হয়।

মধ্যকুমরপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার এ নদীটি এখনো প্রবাহিত হয়। কিন্তু সরকারিভাবে এ নদীটির নদী হিসেবে স্বীকৃতি নেই। বরং ছরা হিসেবেই এটার পরিচিতি বেশি। কুড়িগ্রামেরই রাজারহাট উপজেলার ‘চাকিরপশা’ নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। এ নদীটিও এক প্রজন্ম ব্যবধানে বিল হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এর মূলে নদীর ওপর সরকারিভাবে সেতু ছাড়াই আড়াআড়ি সেতু নির্মাণ।

নদীকে খাল কিংবা বিল বানানোর এ প্রক্রিয়া সারা দেশেই আছে। একটি নদীকে নদী বলা হলে যে ভালোবাসা কিংবা যত্ন দাবি করে নদীকে খাল বলা হলে সেই যত্ন পাবে না। একটি নদী মারা যাওয়ার খবরে যতটা উদ্বিগ্নতা কাজ করবে খালের মৃত্যুতে করবে না। যদিও খালের প্রয়োজনীয়তাও জীবনে কম নয়। সারা দেশে পরিচিতি বদলে ফেলে যে নদীগুলোর নাম খাল হয়েছে সেগুলোর পরিচিতি উদ্ধার করা জরুরি।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সারা দেশে নদী-খাল-জলাশয়ের জন্য করণীয় নির্ধারণ করার নিমিত্তে একটি মাস্টার প্ল্যান করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেই লক্ষ্যে বিভাগভিত্তিক একটি করে কমিটিও করা হয়েছে। এই কমিটি যদি মাঠপর্যায়ে যথাযথভাবে কাজ করতে পারে তাহলেও নদী এবং খালগুলো আলাদা আলাদাভাবে যার যেটি আসল পরিচয় ছিল সেই পরিচয় ফিরে পেতে পারে।

নদীর পরিচিতি হারানোর বাস্তবতা বদলানো না গেলে অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক নদী তারা পরিচিতি হারাবে। একটি নদীর পরিচিতি হারনোর মধ্য দিয়ে তার ইতিহাস-ঐতিহ্যও হারাতে পারে। ইতিহাস-ঐতিহ্য সর্বোপরি সত্যকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে হলেও যার যে পরিচয় আছে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ করতে হবে।

বর্তমান সরকার নদীবান্ধব সরকার। আমরা আশাবাদী সরকার নদী ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তবে অতীতে নদী ছিল বর্তমানে খাল হয়েছে এরকম তথ্য জানা থাকলে তা যারা জানেন তারা উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি, জেলা নদী রক্ষা কমিটি কিংবা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অবহিত করতে পারে। অনেক সময় মাঠ পর্যায়ের খবর জানা কঠিন। দীর্ঘদিনে বদলে যওয়া পরিচিতি স্থানীয় বৃদ্ধ ব্যক্তিরা ভালো জানেন। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংশ্লিষ্টজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ যদি স্থানীয়জনরা করেন এক কাজটি সহজ হয়।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও পরিচালক রিভারাইন পিপল
[email protected]

 
Electronic Paper