ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বনের বাঘ নয়, মনের বাঘের ভয়!

নাজমুল হুদা
🕐 ১০:০৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৬, ২০১৯

কথায় আছে ‘কান টানলে মাথা আসে’। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘মাথা’! কান মাধ্যম মাত্র। এজন্য যতই বলা হোক গুজবে কান দেবেন না তারপরও ‘কান নিয়েছে চিলে’ বলে আমরা সবাই মিলে ‘অদৃশ্য’ চিলের পিছেই ছুটছি! মাথা কাটা হচ্ছে এই গুজবে নিছক ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে এগারজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে সার দেশে।

যে এগারজন হত্যার শিকার তাদের মধ্যে বাক-প্রতিবন্ধী বাবা, বিধবা নারী, সন্তানের মাও রয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে শতাধিক স্থানীয় মানুষ! এই মানুষদের মধ্যে সচেতন, শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নারী, পুরুষ সবাই ছিলেন। শুধু সন্দেহের বশে কাউকে হত্যা করা যায় না, এমনকি প্রকৃত অপরাধী হলেও এটা তারা জানেন।

এতসব জেনেও এতগুলো মানুষ ‘অপরাধীকে’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে না দিয়ে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলেন অনায়াসেই। নিছক ‘ছেলেধরা’ গুজবে কি কাউকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করা সম্ভব, স্বাভাবিক? মানুষের অস্বাভাবিক এই আচরণের প্রচ্ছন্ন কারণ কি শুধুই গুজব? হুজুগে জনতার ক্ষোভের এমন অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ শুধুই ক্ষণিকের উন্মত্ততা? নাকি দীর্ঘদিনে ক্ষয়ে যাওয়া, নুয়ে যাওয়া বিক্ষুব্ধ সমাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়া?

আসলে মানুষের মন-মস্তিষ্ক স্বভাবতই অনিশ্চিত ও অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি আবিষ্ট; আকৃষ্ট। ‘ভূতের’ ভয় আমাদের অবচেতন মনকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। ‘বনের বাঘ নয়, মনের বাঘ’ আমাদের সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। গণধর্ষণ, গণপিটুনি, প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা কিংবা অন্ধকারের ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এসবই যেন আমাদের গা সওয়া ঘটনা, মেনে নেওয়া নিয়তি! এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এডিস মশার উৎপাত, ডেঙ্গুর বাড়াবাড়ি। বন্যার পানি কিংবা গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়াও দুর্ভোগের অংশ। মেনে নিতেই হবে। অনেক কিছু মানুষ মেনে নিলেও, মনে নেয় না। খাঁচায় বন্দি পাখির আকাশে ওড়ার জন্য যেমন ছটফটানি থাকে কিংবা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিকারির ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা থাকে তেমনি বিক্ষুব্ধ মন বিকৃত হতেও সময় নেয় না।

সামান্য দুই টাকা কম ভাড়া দেওয়ার জন্য বাসের যাত্রীরা তুমুল বাক্বিতণ্ডা, চিৎকার চেঁচামেচি, অকথ্য গালাগালি এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত করে। আসলে সমস্যা দুই টাকা বেশি কম নিয়ে নয়। সমস্যা আরও গভীরে। তীব্র গরমে ও প্রচণ্ড জ্যামে অতিষ্ঠ ঠাসাঠাসি করে বাসে ওঠা মানুষ মনে করে তারা নানাভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার। এজন্য ভাবেন, দুই টাকা কম দিতেই পারেন।

একইভাবে কোনো অভিভাবক প্রশ্ন ফাঁস হতে দেখে, শিশু ধর্ষণ হতে দেখে, প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা দেখে কিংবা দু’একটি ‘মাথা কাটার’ ঘটনা শোনে তখন সামান্য গুজবেও ফুঁসে ওঠে। নিজেদের অনিরাপদ ও অসহায় ভাবতে থাকে। মনের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা জমতে থাকে।

সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো ক্ষোভ প্রশমনের জন্য চরম ও চূড়ান্ত অপরাধকেও আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে! বিচার বিবেচনার ধার না ধেরে অন্যায় জেনেও অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে সাধারণ মানুষ। নেত্রকোণা শহরে এক যুবকের ব্যাগ তল্লাশি করে ‘শিশুর মাথা’ পাওয়ার পর তাকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী।

এরপর হত্যার হিড়িক পড়ে গেল সারা দেশে। শহর গ্রামে গুজব এবং পিটিয়ে হত্যা যেন সমান্তরালে চলতে থাকল। গুজবের সুযোগে অনেক পরিকল্পিত হত্যা ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে।

‘ছেলেধরা’ নামক জুজুর ভয়তো বহু পূরণো প্রলাপ! শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থানকে ঘিরে হত্যার গুজব, চাঁদে ‘সাঈদীর’ মুখ দেখা যাওয়ার ঘোষণাও ভুল প্রমাণিত। তাহলে বিজ্ঞান মনস্ক ‘আধুনিক মানুষ’ এখনো কেন পুরনো বৃত্তে আটকা পড়ে আছে?

মানুষের অপরাধপ্রবণ ও অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনটি বিষয় কাজ করে- এক. সামাজিক নিয়ম বা প্রথা, দুই. ধর্মীয় বিধি বা অনুশাসন, তিন. রাষ্ট্র আরোপিত আইন। এই তিনটি উপাদান পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত। যখন কোনো একটি ঠিকমতো কাজ করে না তখন অন্যগুলোতেও ফাটল ধরে।

আস্থার সংকট দেখা দেয়। অনিশ্চয়তা, গুজব তখন আমাদের গ্রাস করে ফেলে। নিরাপত্তাহীনতার চাদরে কুঁকড়ে মুচড়ে পড়া জনগণ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ক্রমেই। গুজবের কারণে সৃষ্ট সমস্যায় কান দিলে সংকট আরও জটিল হতে পারে। শুধু সাময়িক সমাধান নয় প্রয়োজন দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রশমন। সেইসঙ্গে সবাইকে আস্থা ফিরিয়ে দেওয়া এবং সবার সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণে আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

নাজমুল হুদা : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
[email protected]

 
Electronic Paper