ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘অর্পিত সম্পত্তি’র ন্যায়সঙ্গত সুরাহা

আশেক মাহমুদ
🕐 ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০১৯

অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে টানাপড়েন চলছে সেই গত শতকের ষাটের দশক থেকে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে যারা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশ ত্যাগ করে যায়, তাদের সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে সেই শত্রু সম্পত্তি ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নাম ধারণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪৮ বছর কেটে গেল, তবু এই অর্পিত সম্পত্তির কোনো সুরাহা আজ পর্যন্ত হয়নি। এর দায় তখন ছিল পাকিস্তানের, অথচ আমরা এত যুগ ধরে সে দায় মাথায় নিয়ে চলছি, ভাবতে অবাকই লাগে। এখনো সেই সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত হস্তান্তর সম্ভব হয়নি কর্তৃপক্ষের সময়ক্ষেপণ ও গাফিলতির জন্য।

সেই দায় থেকে মুক্তির জন্য সরকার ও রাষ্ট্র দেরি করে হলেও একটা কিছু করতে যাচ্ছে। বর্তমানে সরকারের দখলে থাকা অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ হচ্ছে দুই লাখ ২০ হাজার একর। এসব সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে আদালতে এক লাখ ১৯ হাজার মামলা চলছে। সেই সব মামলার সুরাহা না করেই, সরকারি জিম্মা থেকে অর্পিত সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার প্রাথমিক বন্দোবস্ত চলছে।

খসড়া বিধিমালায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্পিত সম্পত্তি স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কমপক্ষে ১৫ বছর যারা সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে রয়েছেন, এ ধরনের কমপক্ষে ১০ জন কর্মচারী সমবায় সংগঠন গড়ে নিজেদের আবাসিক প্রয়োজনে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য অর্পিত সম্পত্তি স্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিতে পারবেন। এমনকি ৫ শতাংশ সুদে কিস্তিতে এর দাম পরিশোধের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নামে যে সম্পদ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়, তা কিছুতেই ‘শত্রু সম্পত্তি’ তো নয়ই, ‘অর্পিত সম্পত্তি’ ও হতে পারে না। সেই সম্পত্তি ছিল মূলত ‘অপহৃত সম্পত্তি’-যার উপযুক্ত প্রত্যর্পণ ছাড়া এর স্বাভাবিক সমাধান হয় না। পাকিস্তান আমলেও এই অপহৃত সম্পত্তির শত শত একর দখল করে নেয় প্রভাবশালী কায়েমি স্বার্থবাদীরা। এখনো তথ্যমতে, যে দুই লাখ ২০ হাজার একর জমি সরকারের হাতে আছে, তার যৌক্তিক বণ্টন জরুরি হয়ে পড়েছে।

২০০১ সালে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন’ হাজির করা হলেও তা খাতা কলমে পড়ে আছে। সেই আইনের ৫(১) ধারা অনুসারে প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তি উহার মালিকের নিকট বা ক্ষেত্রমতে, প্রত্যর্পণযোগ্য জনহিতকর সম্পত্তি ধারা ১৫ অনুসারে সেবায়েত বা মোহন্ত বা পরিচালনা কমিটির নিকট, প্রত্যর্পণযোগ্য জনহিতকর সম্পত্তির উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, প্রত্যর্পণ করা হইবে; এবং উক্তরূপে প্রত্যর্পিত সম্পত্তির ওপর সরকারের স্বত্ব, স্বার্থ, অধিকার ও সকল দায়-দায়িত্ব বিলুপ্ত হইবে।

এই ধারাতেও সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, অর্পিত সম্পত্তি মালিকের নিকট হস্তান্তরিত হবে অথবা জনহিতকর কাজে প্রত্যর্পিত হবে; কিন্তু এই সম্পত্তির ওপর সরকারের কোনো স্বত্ব, স্বার্থ বা অধিকার থাকবে না। এই দিক থেকে বলা যায়, তথাকথিত ‘অর্পিত সম্পত্তি’র ওপর সরকারের কোনো অধিকার থাকবে না, জনস্বার্থের অধিকার ছাড়া। অথচ দায়মুক্তির নামে এই বিশাল সম্পত্তি সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে বণ্টন করার অথবা তা বেসরকারি খাতে বিক্রি করার মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। কেননা বিক্রির অধিকার তারই আছে যে মালিকানার দাবি রাখে। বরং এখানে বৈষম্য আর অনধিকার চর্চার প্রকটতাই বেশি। এর মধ্যে শুভঙ্করের একটা ফাঁকি রয়েছে। তা হলো, কিছু জমি মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জার জন্য নামকাওয়াস্তে বরাদ্দ দেওয়া হবে, যাতে করে ভাবাবেগ সর্বস্ব এক শ্রেণিকে সন্তুষ্ট রাখা যায়। আর অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য উঠেপড়ে লেগে আছে স্বার্থান্বেষী আমলা মহল ও মুনাফালোভী।

মূলত এত বিশাল সম্পদের ওপর অধিকার রাখে তারা যাদের পূর্বপুরুষ এই সম্পত্তির মালিক ছিল। সেই অধিকার মাথায় রেখে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে হবে সবার আগে। বাকি সম্পত্তির ওপর অধিকার রাখে এ দেশের সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ মানুষ। আর এ বিষয়টি আমাদের সংবিধান স্বীকৃত।

সংবিধানের ১৮(৪) এ বলা হয়েছে, ‘নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান করতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করা যাবে না।’ সরকারি কর্মকর্তা বা বেসরকারি কোম্পানির মালিকরা কি এতই অনগ্রসর যে, তাদের এই সম্পত্তির ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে? জনগণের দাবি হলো ১। উপযুক্ত মালিকদের মাঝে তা প্রত্যর্পণ করা ২। বাকি সম্পত্তি অবহেলিত বঞ্চিতদের মাঝে বণ্টন করার ব্যবস্থা করা। ভূমিহীনদের, এতিমদের, নদীভাঙনের শিকার উদ্বাস্তুদের, নিগৃহীত বিধবাদের চিহ্নিত করে তাদের মাঝে বণ্টন করার জন্য এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন বা খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য জমি বরাদ্দ হতে পারে। কিন্তু আমলাতন্ত্রের হাতে যেন কিছুতেই অর্পিত সম্পত্তি খোয়া না যায়-সে বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[email protected]

 
Electronic Paper