ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জাপানের উজ্জ্বল মুখ মুন্সীগঞ্জের জাকির খান

রাহমান মনি
🕐 ১২:২৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২১

জাপানের উজ্জ্বল মুখ মুন্সীগঞ্জের জাকির খান

নাম তার জাকির খান। জাপানে এই নামেই পরিচিত। তার চেয়েও বেশি পরিচিত খান সান অর্থাৎ মিস্টার খান নামে। যদিও বন্ধু মহল এবং মুন্সীগঞ্জবাসীর কাছে তিনি খোকন নামেই পরিচিত। মা-বাবার সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে হয়তোবা খোকন নামটি হয়ে থাকতে পারে। নাম যা-ই হোক না কেন, তিনি জাপানের দ্বীপরাজ্য ওকিনাওয়াতে বয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের ঝান্ডা। উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। আর বাংলাদেশের ঝান্ডা বয়ে বেড়াবেন না-ই কেন, এই পতাকার জন্যই যে তার অগ্রজ দু’দুইটি ভাই সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে জীবনবাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে যে পতাকা ছিনিয়ে এনে বীরদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন, সেই পতাকা বয়ে বেড়াবার, সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব যে তারই ওপর।

১৯৯০ সালে ভাগ্যের অন্বেষণে জাপান এসেছিলেন জাকির খান খোকন। ভাগ্যের অন্বেষণে জাপানে এলেও জাকির খান ভর্তি হন জাপানি ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটে। এসময় তিনি একটি ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে খণ্ডকালীন চাকরি করতে থাকেন।

JAFLY নামক প্রতিষ্ঠান থেকে জাপানি ভাষা শিক্ষা কোর্স শেষ করে ১৯৯১ সালের শেষের দিকে জাপানের বিখ্যাত ডিউটি ফ্রি শপ LAOX-G (Akihabara) যোগ দেন। সেখানে তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর কাজ করেন। তিনি বিদেশি ক্রেতা বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস সংশ্লিষ্টদের সামাল দিতেন।

LAOX-এ কাজ করার সময় তিনি উপলব্ধি করেন ইংরেজি ভাষার ওপর তার দক্ষতা পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজন ইংরেজি ভাষা এবং কম্পিউটারের ওপর দক্ষতা উন্নয়ন। নতুবা আধুনিক সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কষ্টকর। সেই উপলব্ধি থেকে ঠিক করেন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার উন্নতি করার। মনঃস্থির করেন কানাডা কিংবা নিউজিল্যান্ড গিয়ে ইংরেজি ভাষায় একাডেমিক ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি CBA (Certificate in Business Administration) ডিগ্রিটা অর্জন করা। যেই কথা সেই কাজ থেকে যোগাযোগ করেন কানাডার ক্যালগারি ও নিউজিল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু প্রথম পছন্দ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চ (Old name : CPIT. New name : Ara Institute of Canterbury.)।

ইতোমধ্যে কানাডার ক্যালগারি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চলেও আসে। অপেক্ষা করতে থাকেন নিউজিল্যান্ডের (Old name: CPIT.) আসার। একসময় তা এসেও যায়। কানাডার ক্যালগারি প্রচন্ড শীত বিধায় তিনি নিউজিল্যান্ডকেই বেছে নেন এবং একসময় দুই বছরের জন্য চলেও যান। সময়টা ছিল ১৯৯৫ সাল। এ সময় বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মহল থেকে অনেক বাধা এবং বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও নিজ ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি দুই বছরের জন্য পাড়ি জমান নিউজিল্যান্ডে।

১৯৯৭ সালে নিউজিল্যান্ড থেকে জাপানে ফিরে যোগ দেন HIS ( GBP, AvB, Gm বা হিদের ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস) জাপানের প্রথম সারির একটি ট্রাভেল এজেন্সি’র ‘নাম্বার ওয়ান ট্রাভেল’ বিভাগে। সেখানে ৩ বছর কাজ করার পর সেখানে ইস্তফা দিয়ে একই ধারার ‘হিট ট্রাভেল’-এর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। একই বছর রাজধানী টোকিও ছেড়ে ওকিনাওয়া প্রিফেকচারের এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। বছরটি ছিল ২০০০ সাল।

বড় কোম্পানি ছেড়ে ছোট কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার সুবিধা সম্পর্কে জনাব খান বলেন, বড় কোম্পানিতে দীর্ঘদিন কাজ করলে কাজ শেখা হয়, কাজে দক্ষতা আসে, অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়, এর বেশি কিছু নয়। কারণ, ওখানে কাজ করতে হয় কোম্পানির বেঁধে দেওয়া নিয়মে। নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকে না, নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখা যায় না। কিন্তু ছোট কোম্পানিতে কাজ করতে করতে একসময় নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ এসে যায়। অর্জিত অভিজ্ঞতা নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলা যায়।

একপর্যায়ে কোম্পানি সম্প্রসারণ এবং ব্যবসা প্রসারে জাকির খানের কাছে ওকিনাওয়া থেকে আমেরিকায় বদলির অনুরোধ এলে তা প্রত্যাখ্যান করে ওকিনাওয়াতেই থেকে যান। ওকিনাওয়াতে থেকে যাওয়ার কারণ হিসেবে খান বলেন, বলতে পারেন ওকিনাওয়ার প্রতি প্রেম থেকেই ওকিনাওয়াতে থেকে যাওয়া। কারণ, ওকিনাওয়াতে আমি আমার দেশ বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের গন্ধ খুঁজে পাই। ওকিনাওয়ার আবহাওয়া, মানুষের জীবনযাপনসব কিছুতেই নিজ জন্মভূমির সাদৃশ্য খুঁজে পাই। বলতে পারেন ওকিনাওয়া হলো আমার দ্বিতীয় জন্মভূমি। তবে ওকিনাওয়াতে এতকিছু থাকার পরও খাবার গ্রহণে একটা সমস্যায় ভুগছিলাম। বাঙালি বলে কথা। জন্মের পর থেকেই মশলাযুক্ত অর্থাৎ স্পাইসি খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু এখানে কেবল মশলামুক্ত খাবার খেতে হয়। স্পাইসি খাবার যা-ওবা পাওয়া তা আবার ধর্মীয় বিবেচনায় গ্রহণীয় নয়। রেস্টুরেন্টে খণ্ডকালীন চাকরি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং নিউজিল্যান্ড এবিবিএ (ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেশন) করার সুবাদে ম্যানেজমেন্ট করার আত্মবিশ্বাস সব সময়ই ছিল।

খান বলেন, HIT ট্রাভেলের কর্ণধার সাওয়াদার পরামর্শে ওকিনাওয়াতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল দুইটি। প্রথমত, এখানে আমিসহ আমার মতো যারা স্পাইসি খাবারের সমস্যায় ভুগছিলেন তাদের সমস্যা লাঘব করা। বিশেষ করে হালাল খাবারের। এবং দ্বিতীয়ত ওকিনাওয়াতে আমাদের খাদ্য সংস্কৃতিকে পরিচিতি করানো। যদিও রেস্টুরেন্টের নাম দেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়ান ফুড ‘কাবাব রেস্টুরেন্ট’। কারণ, ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান একই কলোনির অন্তর্ভুক্ত ছিল বিধায় এই তিন দেশের খাদ্য সংস্কৃতির কিছুটা মিল রয়েছে। আর মূল শব্দটি ‘কেবাব’ হলেও আমাদের এই অঞ্চলে তা কাবাব নামেই সমধিক পরিচিত। পরিচিত সবকিছুর প্রতি সবার আলাদা একটা দুর্বলতা থেকেই থাকে। সেই থেকেই ট্রাভেল এজেন্সির চাকরি ছেড়ে জনাব খানের ব্যবসায়ী হিসেবে পথ চলা শুরু।

না, নিয়মিত আয়ের চাকরি ছেড়ে অনিয়মিত আয়ের পথ বেছে নেওয়াটা খানের জন্য ভুল ছিল না। হয়তো কোটি কোটি টাকার মালিক বনে এখনো পৌঁছাতে পারেননি, তবে তার চেয়েও অনেক ওপরে পৌঁছেছেন যেমন নিজে, তেমনি সম্মানিত করেছেন নিজ দেশকে। তার মাধ্যমে ওকিনাওয়াতে পরিচিতি পেয়েছে প্রিয় বাংলাদেশ।

জাকির খান জানান, ওকিনাওয়া পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থান। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অনেক সভা সেমিনার এই ওকিনাওয়াতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর কূটনীতিক এবং পর্যটকরা হালাল খাবারের সন্ধানে ছুটে আসেন কাবাব রেস্টুরেন্টে। কেউ সরবে জানান দিয়ে আবার কেউবা নীরবে-নিভৃতে। এই তো গত বছরের এপ্রিল মাসে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহথির মোহাম্মদ ব্যক্তিগত সফরে ওকিনাওয়া এলে উল্লিখিত বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে আসেন এবং মধ্যাহ্নভোজ সারেন। যদিও সে সময় জাকির ব্যবসায়িক কাজে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন।

ওকিনাওয়াতে ইয়ং বিজনেস পারসন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন খান। একজন ইয়ং বিজনেসম্যান হিসেবে খানের নাম এখন পুরো ওকিনাওয়াব্যাপী। নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন বিভিন্ন চেম্বারস এবং স্থানীয় সামাজিক সংগঠনসমূহের সঙ্গে। কেবল জড়িতই শুধু নন, কাঁধে নিয়েছেন নেতৃত্বও। ওকিনাওয়া প্রিফেকচার ফুড এবং বেভারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বভার তার ওপর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যদিও এটা অবৈতনিক তথাপি অত্যন্ত সম্মানজনক।

শুধু বাংলাদেশি হিসেবেই নন, একজন বিদেশি হিসেবে ওকিনাওয়ার খান জাপানের ৪৭টি প্রশাসনিক জেলার মধ্যে প্রথম এবং একমাত্র বিদেশি হিসেবে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ অ্যাসোসিয়েশন অফিসের সর্বোচ্চ (নির্বাহী প্রধান) পদে আসীন।

রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছাড়াও জাকির খান বর্তমানে বাংলাদেশে ফেব্রিক্সের ব্যবসা করছেন। বাংলাদেশি পণ্যকে জাপানের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে পরিচিত করে চলেছেন। জাপানি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করানো এবং বাংলাদেশি পণ্যকে জাপানে বাজারজাত করার কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।

জাকির খান বর্তমানে জাপানের নামীদামি (ব্র্যান্ড মেকার Aeon, Right-On, Shimura ETC) কোম্পানিগুলোর পোশাক শিল্পে তাদের চাহিদা মোতাবেক পণ্য বাংলাদেশ থেকে তৈরি করিয়ে এনে জাপানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে প্রমোট করাসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। তার পরিচালনায় জাপান-বাংলাদেশ যৌথ কোম্পানি বাংলাদেশি পণ্য জাপানের বাজারজাত করার মান নিয়ে কাজ করে থাকে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি)।

ব্যক্তি জীবনে জাকির খান খোকন জাপানি তরুণীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক কন্যা সন্তান এবং দুই পুত্র সন্তানের গর্বিত পিতা। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রয়েছে তার সুখের সংসার। মুন্সীগঞ্জ শহরের ডানপিটে ছেলেটি আজ জাপান জয় করে নিজ দেশের পতাকা সমুজ্জ্বল রেখেছেন।

রাহমান মনি: প্রবাসী লেখক

[email protected]

 
Electronic Paper