জাদুকরী প্রহসনে বিবেকের দহন
মোশতাক আহমেদ রুহী
🕐 ৮:৫৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০১৯
রাষ্ট্রের শরীরে পচন ধরেছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা যেসব খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর অন্যতম নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। চোখে ধুলা দিয়ে জাদুকরের ম্যাজিকের মতো ইন্দ্রজালিক কারচুপি করে তারা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে যাচ্ছে।
এসব পরিতাপের কারণেই শুরু হয়েছে বিবেকের দহন, সেখানে সত্যকে সাহস করে সত্য বলে স্বীকার করার সুযোগ নেই, বিশাল চক্র নিজেদের স্বার্থে সব কিছু দখলে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মিথ্যার লীলাখেলা।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ যে স্তম্ভগুলোর কথা বলেছি, সেগুলো জড়িয়ে আছে স্বার্থবাদী দালালচক্র। তাদের দেশপ্রেমহীন বিষবাষ্প বিবেকহীন ও মিথ্যা মূকাভিনয়ে ধোঁকায় ফেলছে সবাইকে। কিন্তু এই চক্রটি এতই শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা তাদের টিকিটিও স্পর্শ করা যাচ্ছে না।
একশ্রেণির বেপরোয়া অর্থলোভী বিকারগ্রস্ত মানসিকতার তথাকথিত রাজনীতিবিদ, বিচারক, সরকারি কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাচারী পুলিশ দেশের সাফল্য উন্নয়ন মলিন করে দিচ্ছে। মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আইন-কানুনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে করছেন। তাদের এই প্রভুসুলভ আচরণের কারণে অনেকেই প্রকাশ্যে বলেন, এই সরকারকে তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছে। এরাই লুটেরা বিত্ত-বাসনায় গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে।
এরা মনে করে দেশটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নয়, আমলা ও লুটপাটতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে সমাজের নানা স্তরে এসবের যে আলামত দেখা দিচ্ছে, তা নিশ্চয়ই ভালো লক্ষণ নয়। এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে, মানুষের স্বস্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সৎ, দেশপ্রেমিক, মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মেধাবীদের মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতি আর মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, লাল-সবুজের পতাকা জনগণকে দেশের মালিকানা দিয়েছে। অথচ যার যা কিছু আছে তা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষগুলো আজ বড় অসহায়। নিজ দেশে তারা নতুন বেনিয়ার কবলে, পরবাসী।
সবখানে সাধারণ মানুষের কষ্টের দীর্ঘশ্বাস। এখানে দুষ্টচক্রের বাড়াবাড়ি আর লুটপাটের চিত্র গা সয়ে গেছে। দিন শেষে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠলেও সুবিধাবাদীরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। জনগণ কোথাও কোথাও চাকরের মর্যাদাও পাচ্ছেন না।
বহুমুখী অনিয়ম এখানে অর্থের বিনিময়ে সাদা হয়েছে। অবাক হলেও সত্য, সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠানের রাজস্বের পাওনা কোটি কোটি টাকা পরিশোধ না করে আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগও প্রকাশ্যে এসেছে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, নির্বাচনী বিধিকে তোয়াক্কা না করে নির্বাচন কমিশন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। হাওর এলাকার এক এমপির উত্থান চরম বিস্ময়কেও হার মানিয়েছে। এখানে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ও অকার্যকর হয়ে গেছে। এমপি প্রার্থী হওয়ার আগে বা প্রার্থিতার বৈধতার জন্য সরকারি পাওনা আদায় বা ব্যাংকে জমা দেওয়ার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে।
রিটের মাধ্যমে সময় পাওয়া গেলে সে সময় পরে রিটের কার্যকর থাকে না, টাকা জমা দেওয়া তখন বাধ্যতামূলক হয়ে যায় অথবা রিটকারী সাবেক দায়ে দণ্ডিত হন। নির্বাচন কমিশনের হলফনামার ৬(গ) ধারা মোতাবেক সরকারি পাওনা গোপন করলে অথবা সরকারের কাছে দায় থাকলে নির্বাচনে প্রার্থী অযোগ্য হয়। শুধু তাই নয়, এটি একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও গণ্য হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার ব্যাংকের পাওনা টাকা জমা না দিয়ে হাওরের আলোচিত ওই ব্যক্তি এমপি প্রার্থী হয়েছেন, বিজয়ী হয়ে তিনি সংসদেও গেছেন।
রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধনের জন্য রিট পিটিশন সংশ্লিষ্ট সাবেক অপসারিত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ অন্য বিচারপতিরা (সিনহাসহ হাইকোর্ট বিভাগের তিনটি বেঞ্চে রিটের রায়গুলোতে যাদের স্বাক্ষর আছে) কি দায় এড়াতে পারেন? সে ঘটনার পরে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছিল রিটের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার কোনো রিভিউ পিটিশন দায়ের করেননি। যা শতভাগ মিথ্যা।
সরকার রিভিউ পিটিশন করেছে এবং তার সমস্ত দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু সে সময় আলোচিত ওইসব বিচারপতির যোগসাজশেই এ অপকর্ম সম্ভব হয়েছে। এক কথায়, একটি অভিনব প্রতারণা ও ভেল্কিবাজির মাধ্যমে একজন অযোগ্য প্রার্থীকে যোগ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। গত ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের পর রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
এই নজিরবিহীন ও প্রশংসিত পদক্ষেপ বিচারপ্রার্থীদের আশাবাদী করেছে। জাদুকরী প্রহসনে বিবেকের দায় মেটানোর জন্যই বিষয়টি তুলে ধরা হলো। একটু দেরি হলেও বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনে এ উদ্যোগ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। একই সঙ্গে কলুষমুক্ত বিচার বিভাগ জাতির জনকের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে সর্বক্ষেত্রে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে বলে আশা করছি।
মোশতাক আহমেদ রুহী
সাবেক সংসদ সদস্য