ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আকাশের বাইরে

আনোয়ার রশীদ সাগর
🕐 ৩:২১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০১, ২০২১

আকাশের বাইরে

চন্দ্রছোঁয়ায় জেগে উঠি বারবার।
পৌঁছে যাই নীরবতার প্রাচীর ভেঙে কোলাহলে। সে কি জানে চন্দ্র? নাকি দূরদেশে চন্দ্রহাসি হেসে হেসে শুধু ভাঙাগড়ার কথা বলে হারিয়ে যায় আলো-আঁধারিতে, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।

একদিন আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা ঘোর সন্ধ্যায় সে এসেছিল নীরবে নিভৃতে। বাগানটা ঠিক নানিদের বাড়ির দক্ষিণে, ঘর সংলগ্ন। আমি কেন কোন টানে সেখানে গিয়েছিলাম জানি না। তখন আশির দশক। আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে মুক্ত হতে প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছি। দূর সমুদ্র পাড়ি দিতে নৌকায় উঠে পালিয়ে যাওয়ার মতো করে যাচ্ছি, তো যাচ্ছিই। মেহেরপুর শহরের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে আসতে পারলেই মুক্তি পেয়ে যাব এমনই ধারণা ছিল। উজলপুর গ্রাম থেকে হেঁটে হেঁটে কাথুলি রোডের কাছে এসেছি। ঠিক তখনই পুলিশ তাড়া করে। দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে দৌড়াতে গোবিপুর পার হয়ে ভৈরব নদীর ধারে পৌঁছে গেছি। ভাবছি, প্রয়োজনে নদী পার হয়ে ভারতে ঢুকে পড়ব। কিন্তু নদীর ধারে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালাম খরগোশের মতো কান খাড়া করে। দেখি পেছনে কেউ নেই। আমার কাছে রয়েছে একটি ভাঙাচোরা জংধরা পিস্তল। এটাই সম্বল। পার্টির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে পালিয়েছি। তখন আমাদের পার্টির দুর্দিন চলছিল। সংশোধনবাদী আখ্যা দিয়ে অপর একটি গ্রুপ একের পর এক হত্যা করে চলেছে। সকলেই জীবন বাঁচাতে মরণ পণ লড়াই করছে। আর আমি পালাচ্ছি কাপুরুষের মতো। আমার মনে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনই দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লবকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাছাড়া বাংলাদেশের মতো সমতল জায়গায় যেভাবে পুলিশ বাড়ছে, ধনিক শ্রেণির আধিপত্য লাগামহীন হচ্ছে সেখানে বিপ্লব করা কঠিন কাজ। তারপর চারু মজুমদারের পতন, সিরাজ সিকদারের পতন আমার মনোবলকে ভেঙে ফেলছে প্রতিদিনই। যদিও বেঁচে রয়েছে কমরেড হক, টিপু বিশ্বাস, বিমলসহ অনেকেই। কিন্তু তাদের নেই একতা বা ঐকমত্য। নিজেদের ভিতরও চলছিল ভাঙাভাঙি এবং বিশ্বাসহীনতার সংস্কৃতি। স্বৈরশাসক এরশাদের আগ্রাসনও কম নয়।
পালাতে পালাতে ভৈরব নদীর ধারে অপেক্ষা করছিলাম। রাত গহিন এবং নিকষ অন্ধকার ছিল। কিনারেই কাটিয়ে দিলাম বাকিটা সময়। ভোরের আজান হয়ে গেছে। একেবারে পাশেই ভারত সীমান্ত। শুধু ছোট নদীটা মাঝখানে। আনমনা হয়ে একটি বাড়িতে উঠে পড়েছিলাম। খেয়াল করে দেখি, বাড়িটা সনাতন ধর্মের এক ভদ্রমহিলার। ইচ্ছে করেই পিস্তলটা দেখানোর ভান করে বের করতে করতে বলেছিলাম, কাকিমা আজকের দিনটা আপনার এখানে থাকতে চাই।
কাকিমা বলল, থাকো বাবা। আমার কেউ নেই। ছেলেমেয়ে-স্বামী ওপারে ওই গ্রামে চলে গেছে। বলে, হাত দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করল ভারতের কোনো সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামের বাড়িকে।
আমি নীরবে ঘরের ভিতরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। তাকিয়ে দেখি, কাকিমা কিছু খাবার আমার মাথার কাছেই রেখে দিয়েছে। গোসলের প্রয়োজন হলেও ভয়ে বের হলাম না। একদিকে পুলিশের তাড়া অপরদিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রতিপক্ষ গ্রুপের আক্রমণ। ক্ষুধার্ত আমি দ্রুত খেয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। গোধূলি পেরিয়ে ঘোর সন্ধ্যা হলে বের হলাম। বাগানটির ভিতরে এসে অবাক হই। রিক্তা! কীভাবে এলো সে?
রিক্তার সঙ্গে আবেগঘন কথার ভিতর দিয়ে জানলাম এখানেই ওর নানির বাড়ি। ওর সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল দু’বছর আগে। সে সম্পর্ক ত্যাগ করে যোগ দিই আন্ডারওয়ার্ল্ডে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে অঙ্গীকার করি, অস্ত্র ধরি। মাত্র দু-আড়াই বছরের মাথায় এসে খেই হারিয়ে ফেলি। ভাবতে থাকি কবে কখন পালাব। সেই পালাতে গিয়েই আবার দেখা হয়ে যায় রিক্তার সঙ্গে। আহা রিক্তা। আফসোস হতে থাকে, যখন জানতে পারি রিক্তা মামাত ভাইকে বিয়ে করে বিবাহিত জীবনযাপন করছে।
চলে যায়, অভিমানে-ক্ষোভে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে। আবার ফিরে আসি চার বছর পরে, শুধু রিক্তার জন্য।
বাংলাদেশ থেকে এক বন্ধু ভারতে গিয়েছিল। তার সঙ্গে দেখা হলেই জানতে পারি রিক্তার স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তাই বারবার ওর মলিন মুখটা মনে পড়তে থাকে। মোমের মতো গলতে থাকে আমার ভিতরের অভিমানটুকু, চলতে থাকে জীবনের চাকা। হাতড়াতে থাকি মাঠেঘাটে শূন্যস্থানে। হাঁটতে থাকি মেঠোপথে, একবার সাঁতার কাটতে চাই জীবনসংসারে।
ধূলিকণার মতো ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ গৃহকোণে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠি। শুধু একবার আমার রিক্তাকে প্রয়োজন, একবার রিক্তার মলিন মুখে হাসি ফোটাতে চাই। ওর জীবনের বৈশাখী ঝড় আমার বুকজুড়ে বিরহে, আষাঢ়ের বর্ষা টেনে আনে। নিজের বুকের তলটা শুকনো উদ্যান মনে হয়। কেন এমন হতে থাকে বুঝতে পারি না। নিজেকে নিয়ে ভাবি আর হাঁটি কার্নিশে কৈশোরে হাঁটার মতো। ভিতরে ভিতরে চিৎকার করে ওঠে, ‘আমি চাই মুক্ত জীবনÑ এ জীবন চাই না।’
ক্লান্ত আঁধারে নীরবে কেঁদে উঠি।
আমি বিপ্লবী হওয়ার যোগ্যতা রাখি না। নতমুখে ভীরুপ্রাণে যেতে যেতে মরিচাধরা অস্ত্রটা ফেলে দিই নদীর ভিতরে, ফেলে দিই সমাজতন্ত্রকে হৃদয়ের গহিন থেকে। অথচ মার্কসবাদ আমাকে যে টর্চলাইট দিয়ে গেছে তা কী করে ভুলি?
জোনাকির মতো জ¦লে জ¦লে ওঠে অন্তর। মূল্যায়ন করে ফেলি যে কোনো প্রাণীকে, মানুষকে তো বটেই। ঠাঁই করে নিই গোপনে মালশাদহ গ্রামে। গাংনী উপজেলা থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। এখানেই রিক্তার বাবা মহিত চাচার বাড়ি।
এদিকে ধীরে ধীরে এলাকা থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাঘা বাঘা নেতা হারিয়ে যেতে থাকে। কেউ পুলিশের খাঁচায় বন্দি হয়, কেউ নির্বিচারে হত্যা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা। আবার কেউ কেউ সারেন্ডার করে সরকারি দলে যোগ দিতে থাকে।
কয়েকদিন থাকতে থাকতেই জানতে পারি রিক্তা তার বাবার বাড়িতেই রয়েছে।
আর সেদিন থেকেই কত যে সন্ধ্যাঘোরে অপেক্ষা করতে থাকি! আহা তবুও দেখা হয় না। ছেঁড়াফাটা জীবন নিয়ে সে নাকি বাড়ির মধ্যেই থাকে। মনে মনে পরিকল্পনা করতে থাকি, আমি যে এসেছি সেই খবরটা পৌঁছে দেব রিক্তার কাছে। তারপর দেখব ওর প্রতিক্রিয়া।
অপেক্ষা আর অপেক্ষা। সবুজ মাঠে সেচ দেওয়ার পর, বক যেমন অপেক্ষা করে কীটপতঙ্গ অথবা দাড়কি-পুঁটির জন্য তেমনই শুধু অপেক্ষা করতে থাকি। যে বক ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, বাতাসের বিপরীতে সাদা পাখা মেলে উড়তে থাকে, সংগ্রাম করতে থাকে বাঁচার জন্য সে বকটিকে ধরার জন্য গুলি করে জমিদার অথবা ধনীর দুলালরা।
নিজেকে শুধু হাড্ডিসার সাদা বকের মতোই মনে হতে থাকে। আমিও দীর্ঘদিন স্রোতের বিপরীতে উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকি মাঠে-ঘাটে, মেঠোপথে অথবা কখনো ঘরের কোণেও।
মাসখানেক পরে বুঝতে পারি মুখের দাড়ি বেশ বড় হয়ে গেছে। এদিকে রাষ্ট্রীয় অস্থিরতার মধ্যে চলছে দেশ। আন্দোলনের মাঠে সকল দল একসঙ্গে নেমেছে। আমাকে চেনার উপায় নেই। টুপি মাথায় দিয়ে একদিন কুষ্টিয়া শহরে বেড়াতে গেছি। সেইদিনই হঠাৎ শুনতে পাই স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়ে গেছে। আনন্দ করছে, সব ছাত্র সংগঠন এক হয়ে, ছাত্রদল-ছাত্রলীগ-ছাত্রমৈত্রী-ছাত্র ইউনিয়ন এমনকি ছাত্রশিবিরও।
শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী কোনো কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন সম্পর্কে আমার জানা নেই। তাদের মিছিল-মিটিংও দেখছি না। শহরের অলিগলিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক টহল হলেও আমার মন থেকে ভয় শব্দটা হারিয়ে যায়। জড়তাহীন ঘুরে বেড়াচ্ছি শহরের ভিতরে ভিতরে।
কী আশ্চর্য! যার প্রতীক্ষায় কাটছে দিন, সে এখন আমার সামনে একেবারে মুখোমুখি লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সদর হাসপাতালে যেতে যেতে যে রাস্তার সঙ্গে শিশুপার্ক রয়েছে, ঠিক সেখানে নবীন কিছু গাছের ছায়ায় আমাদের দুজনের দেখা হয়ে যায়। আবেগঘন মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, তোমাকে খুব-খুব ভালোবাসি রিক্তা।
কিন্তু সে কথা বলা আর হয় না। কয়েক সেকেন্ড সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থেকে, রিক্তা তার নতুন স্বামীর হাত ধরে হাঁটতে থাকে হাসপাতালের দিকে। আমি নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি, চেয়ে চেয়ে দেখি। একবারও নববধূটি আকাশের নির্দিষ্ট ঠিকানার বাইরে তাকাল না। একবারও না।

 
Electronic Paper