ঢাকা, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘রাজা চেক’ কবি সাম্য শাহর সাহসের সমাচার

মুহাম্মদ ইয়াকুব
🕐 ৭:৪৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০২৪

‘রাজা চেক’ কবি সাম্য শাহর সাহসের সমাচার

‘আমি কখনো তোমাকে লিখিনি কোনো কবিতায়/আমাকেও না। কোনো ফুল লিখিনি/পাখি বা প্রজাপতি কিংবা নদী অথবা নারী/আঁকিনি কোনো শব্দের অলংকারে। অথচ/বেনারসি যৌবনা তুমি বেড়ে উঠেছো আমার প্রেমের ডগায়।’ পঙ্ক্তিটি এবারের বইমেলায় প্রকাশিত কবি সাম্য শাহর সাহসের সমাচার ‘রাজা চেক’ কাব্যগ্রন্থের। নারী কিংবা ফুল-পাখি নয়, কবি সাম্য শাহ লিখেছেন সময়কে। গ্রন্থটির পাঠপ্রতিক্রিয়ায় সংকোচে বলতে বাধা নাই, সাম্য শাহ কালের প্রহরী হিশেবে কবিতায় রাজপথ মুখরিত করা ক্ষুদ্র কবিদলের অগ্রপথিক হয়ে যুগের পর যুগ আলো ছড়াবেন অন্ধকার জনপদে।

 

সাম্য শাহ আমাদের সময়ের কবি। তাঁর আর আমার পৃথিবীতে আগমনের সময়কাল একই সালে। আমাদের সময়ের কবিরা যখন সময়কে ধারণ করতে ব্যর্থ, সাম্য শাহ তখন স্বকীয় মহিমায় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম, যে বুক চেতিয়ে জ্বলজ্বল করে তমসাচ্ছন্ন আকাশে। সময়কে ধারণ করে নিজস্ব কাব্যভাষা সৃষ্টিতে সাম্য শাহ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, অভিনব ও ব্যতিক্রম কবি। তাঁর কবিতা ভাব-ব্যঞ্জনায় গভীর, উপমা-উৎপ্রেক্ষায় চিত্তাকর্ষক, কাব্যভাষার নির্মাণশৈলী সরল, রূপক-প্রতীকে অনন্য এবং সময়কে ধারণে সিদ্ধহস্ত। বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাম্য শাহর কবিতা অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সদা সরব, অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর, মানবতার প্রশ্নে আপসহীন। এক সাগর রক্তে অর্জিত এই জাতিরাষ্ট্র নিয়ে কবির স্বপ্ন অনেক উঁচু। অথচ, এখানে সচেতনভাবে বিভেদের চাষ করা হচ্ছে আমাদের অবচেতন মূর্খ মস্তিস্কে,- ‘বিগত অভিমান, সমস্ত চুমু যেনো নিমিষেই ঘাতকের বুটের আওয়াজ। কোনো কৈফিয়ত নেই; সোজাসাপ্টা/উত্তরে সপ্ন্নের বাগানে ফুটে উঠলো হিংসার ফুল!’

পুঁজিবাদের রমরমা ক্যানভাসে মানুষ আর মানুষ নাই! নিষ্ঠুর পুঁজিবাদী সভ্যতার বীভৎসতায় কবি যারপরনাই ব্যথিত। সাম্য শাহ সাম্যবাদী কবি। কথিত সাম্যবাদ নয়, প্রকৃতার্থে সাম্যবাদে বিশ্বাসী কবি তাঁর জনগণকে পুঁজিবাদের হটকারীতা সম্পর্কে সজাগ করবার প্রয়াস চালিয়েছেন ‘রাজা চেক’ কাব্যগ্রন্থে,- ‘তুমি আমাকে খুলে দেখো/জাতিসংঘের পতাকা কেমন উড়ছে দেহে/হঠাৎ ধ্রুপদী মিথ্যার রঙে বিজ্ঞানের মতো/রঞ্জিত- বিজ্ঞাপন হয়ে গেলে; অথচ মানুষ/ছিলে পুঁজিবাদী দুনিয়া জন্মাবার আগে!’

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কিছুই আর হারাবার থাকে না! কবিরও হারাবার মতো কিছুই নেই,- ‘আমার কিছুই আর হারাবার নেই/না প্রেম, না হিংসা - অবশিষ্ট নেই/ফাগুন অথবা বর্ষার থইথই জল/আমি সব হারা নষ্ট-ভ্রষ্ট পথ/আমি সর্বহারা মাতাল মতামত।’

এমতাবস্থায় সত্য ও মিথ্যার ন্যায় কবি এবং বন্দুকের নল পরস্পর মুখোমুখী। সম্মুখ-সংঘাতের অনিবার্য বাস্তবতায় আল্লাহর সাথে ওয়াদাবদ্ধ কবির সাহসের সমাচার,- ‘আল্লাহর সাথে মুখোমুখী/ওয়াদায়, বাজি রেখে জীবন; বন্দুকের সাহস/লেলিয়ে দিলাম, ফ্যাসিস্ট বুলেটের বিপরীতে।’

নারী-জাগরণ ব্যতীত কোনো বিপ্লব হতে পারে না, কোন জনপদে হতে পারে না কোনো বিপ্লবীর জন্মও। তাই সাম্য শাহর কবিতায় প্রেম ও নারী হয়ে ওঠে রক্তরাঙা প্রতিবাদের তরবারি। নারীর প্রতি কবির আহ্বান, বিছানায় নয়, ঝড় তোলো মিছিলে,- ‘বিছানায় নয়, নারী/মিছিলে ডেকো তারুণ্যের ঝড়ে।’

পরিবর্তনের জন্য নারী ও তারুণ্যের জাগরণ অপরিহার্য। তাই নারীর সাথে সাথে তারুণ্যের প্রতি কবির আহ্বান, অধিকার আদায়ে হও বদ্ধপরিকর। কবির বিশ্বাস, নুহের প্লাবন মানে আরেকটি নতুন সভ্যতার সৃষ্টি। ধ্বংসের ঝড়ো উল্লাসে বিধ্বস্ত নারীর বিছানায়ই জন্ম নেয় পৃথিবীর নতুন সূর্য। তাই রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে কবি নারী ও তারুণ্যে দেখতে চান ট্রিগারে আঙুলের নৃত্যপর উল্লাস,- ‘লেলিয়ে দাও আঙুল, নারী কিংবা ট্রিগারে/হে যুবক, ধ্বংস আর সৃষ্টি তোমার অধিকার।’

নারী-জাগরণে সাম্য শাহর দর্শন আর দশজন থেকে কিছুটা ভিন্ন। কবি নারী-জাগরণ দেখতে চান কিছুটা ভিন্ন আঙিকে, যেখানে নতুনত্ব ও অভিনবত্ব স্পষ্ট ক্রিয়াশীল,- ‘ঘোমটা খুলে জেগে উঠো নারী; দেখো/আকাশে জ্বলে উঠা জ্যোৎস্নার তরবারি।’

কবি সাম্য শাহ স্বপ্ন দেখেন একটি নতুন পৃথিবীর, যেখানে তাঁর স্বপ্নভ্রুণেরা ঘুরে বেড়াবে খোলা আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। যে পৃথিবীতে থাকবে না কোন স্বৈরাচার, স্বেচ্ছাচার, একনায়ক কিংবা ফ্যাসিস্টের ছায়া। এমন শৃঙ্খলমুক্ত নয়া দুনিয়ার প্রত্যাশায় কবি লিখেন বিপ্লবের নয়া ইশতেহার,- ‘পৃথিবীর ভেতর আরেকটি পৃথিবীর জন্ম হলেই মুক্ত/হবে আমাদের শৃঙ্খল। আমি বলে দিচ্ছি দেখে /নিয়ো প্রতিটি নদী ও নারীর কিংবা পিতা আর তপ্ত/মিছিলের ঔরশজাত ইতিহাস! দেখে নিয়ো আমার/সার্থকভ্রুণেরা জন্মকথা আগামীর একেকটি বিপ্লবে।’

হাজারো দুঃসংবাদের ভিড়েও কবি হতাশ নন। প্রকৃত কবি মাত্রই হতাশার সাগরে ভেসে যাওয়া নয়, ঘোর অমানিশায় নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় থাকা। সাম্য শাহও আশাবাদী কবি,- ‘মরে যাচ্ছে প্রিয়/মানুষকে নাম ধরে ডাকবার অধিকার। আমি প্রতিনিয়ত মরে যাচ্ছি/জন্মাবার নতুন স্বপ্ন নিয়ে। ওরা আমার স্বপ্ন লুটে নিতে চায়; অথচ/এখন শেষ রাত, সামনেই নতুন দিনের নতুন সূর্য।’

যারা মানুষকে মানুষ মনে করে না, মনুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারে বিশ্বাস করে না, পরমত দমনে বন্য হিংস্রতা লালন করে মগজে, তাদের প্রতি কবির চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি পদাবলী উচ্চারণের সাথে সাথে জনতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান,- ‘ওদের দুনিয়া ছোট হয়ে গেছে/এখন চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়; বিপ্লবের প্রস্তুতি গ্রহণ করো বন্ধু!’

উপমার অভিনবত্বে সাম্য শাহর কবিতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাঁর কবিতার শরীর নারীদেহের ভাঁজের মতো মসৃণ। বহুদর্শী কবির কবিতায় প্রেমিকার হাসির মতো হাসে নতুন বাংলাদেশ,- ‘প্রেমিকার মতো হাসে মুক্তির মুখ/বিপ্লবী রক্তে চিকচিক করে/আগামীর নতুন সূর্য, স্বাধীন সার্বভৌম/কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ।’

সেদিন অর্থহীন জলসার সব আলো নিভে যাবে। ভাড়ায় খাটা শিল্পমূল্যহীন নর্তকীর নাচ বন্ধ হয়ে যাবে। হাসবে শুধু কবিতার রাজপথ। নক্ষত্রের মতো তেজোদীপ্ত আলোয় জ্বলবে কবি,- ‘জলসার সব আলো/নিভে যাবে ইশারায়/জ্বলে উঠবো আমি।’

সাম্য শাহ সমকালীন বাংলা কবিতার নতুন কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতায় বিপ্লব ও শিল্প একাকার হয়ে নয়া কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছে। কাব্যগ্রন্থটির শরীর নাড়াচাড়া করে সবাই একমত হবেন, নিজস্বতা ও স্বকীয়তায় অনন্য কবি সাম্য শাহর ‘রাজা চেক’ এর নামকরণ যথার্থ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সাম্য শাহর কবিতা পাঠ করে কোন পাঠকই ঠকবেন না। মাহমুদুর রহমান মান্না, কবি আব্দুল হাই শিকদার ও কবি আবিদ আজমকে উৎসর্গকৃত ‘রাজা চেক’ কাব্যগ্রন্থটি খ্যাতিমান শিল্পী চারু পিন্টুর প্রচ্ছদে প্রকাশ করেছে ঐক্য প্রকাশন। বইটি সদ্য শেষ হওয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পাঠকের মনযোগ কেড়েছে।

 
Electronic Paper