নিজেকে জানতে সহায়ক গ্রন্থ ‘যোগাযোগের সহজপাঠ’
তানিয়া সুলতানা
🕐 ৮:০৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ২২, ২০২৪
প্রতিটি মানুষই ভিন্ন বা অদ্বিতীয়। এই ভিন্ন মানুষ আরেকজন বা একাধিক ভিন্ন মানুষের সাথে সংসার করে, বন্ধুত্ব করে কিংবা সংগঠন চালায়, একত্রে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। মানুষকে আরেকটা মানুষের সাথে যোগাযোগ করতেই হয় এর কোনো বিকল্প নেই। কৃষিভিত্তিক সমাজে যোগাযোগের গুরুত্ব আমরা আলাদাভাবে ঠাওর করতে পারতাম না। কারণ মানুষ তখন থাকত নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির ভেতর, ভিন্ন সমাজ বা সংস্কৃতির লোকের সাথে ওঠাবসার সুযোগ ছিল কম। কর্মক্ষেত্র ছিল নিজ পরিবারের জন্য সুনির্দিষ্ট পেশা। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর, বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে যোগাযোগ এবং কর্মদক্ষতার বিষয়টি ওতপ্রোত হতে শুরু করল। গোটা দুনিয়া একটা ছোট গ্রামে পরিণত হয়েছে এখন- যাকে আমারা গ্লোবাল ভিলেজ বলছি। এখন যোগাযোগ একই সাথে চ্যালেঞ্জিং এবং দরকারি বিষয়। ফলে মানবীয় যোগাযোগ আধুনিক জ্ঞানচর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশে বাংলাভাষায় কার্যকর যোগাযোগের বই হাতে গোনা যাবে। ‘যোগাযোগের সহজপাঠ: ক্লাসরুম থেকে কর্মজীবন’ সেক্ষেত্রে শূন্যস্থান পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস। বইটিকে আমি কার্যকর বলছি তার কারণ বইটি অনেকটা আত্মন্নোয়ন ধাঁচের। অর্থ্যাৎ বইটি মন দিয়ে পাঠ করলে আপনার যোগাযোগ দক্ষতা বাড়বেই। বইটির সবথেকে মনোগ্রাহী দিক হল অনুশীলনীর অন্তর্ভূক্তি। এতে করে প্রতিটি অধ্যায় শেষে পাঠক নিজেকে যাচাই করে যেমন নিতে পারবে, তেমনি করে নিজের জন্য অভীষ্ট লক্ষ্যও তৈরি করে নিতে পারবে। বইটি যুগ্মভাবে লিখেছেন সামিয়া আসাদী এবং ডা. হাসান মাহমুদ। পেশাগত জীবনে দুইজনই যোগাযোগ নিয়ে কাজ করেন। সামিয়া স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বিভাগে যোগাযোগ পড়ান আর ডা. মাহমুদ করপোরেট দুনিয়ায় কর্মীদের আত্মন্নোয়ন নিয়ে কাজ করেন। ফলে ক্লাসরুম থেকে কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ এবং আত্মন্নোয়নের চাবিকাঠি নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেছেন বইটিতে। পাশাপাশি বইটি কেবল কার্যকরই নয় বরং যোগাযোগের মূল তত্ত্বীয় দিকগুলোও সাবলীলভাবে বইটিতে এসেছে। ফলে সাধারণ পাঠকদের যেমন তত্ত্বগুলো ভারী মনে হবে না আবার শিক্ষার্থীরাও তত্ত্বীয় আলোচনা থেকে বঞ্চিত হবেন না।
কী আছে এই বইতে? খুব কঠিন কিছু নেই। সক্রেটিসের সেই প্রাচীন উক্তিই যেন যোগাযোগের এই বইটির প্রাণ‘নো দাই সেল্ফ’ নিজেকে জানো। আমি আসলে লোকটি কেমন ধরনের সাদামাটা, স্ট্রাকচারড নাকি সৃজনশীল কিংবা উদ্ভাবক! কেমন ধরনের কাজ/ কর্মক্ষেত্র বা পড়াশোনা করলে আমি আমার সর্বোচ্চটা যেমন দিতে পারব তেমনি কাজটা উপভোগ করব? জব স্যাটিসফ্যাকশন মিলবে কিসে? পরিবারে নানা প্রজন্মের লোক, অন্তত তিনটি প্রজন্ম তো থাকেই আরো বেশিও থাকতে পারে! কেমন করে ঘোচাবো প্রজন্ম ব্যবধান? আর অফিসে তো আরো বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশে কী করে নিজেকে মানিয়ে নেয়া যেতে পারে সে সংক্রান্ত দিক-নির্দেশন রয়েছে বেশকিছু থিম ধরে ধরে। কর্মক্ষেত্রে পোশাক সাজগোজ স্টাইলিং আমরা যা বলি কিংবা বলি না কীভাবে নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করে, বর্তমান সময়ে নেতৃত্বের ধারণাটাই বা কী রকম, কীভাবে নেতৃত্বের গুণাবলী চর্চা করতে হয় এসবকিছু খুব সুন্দরভাবে তুলে আনা হয়েছে। সেই সাথে আছে দলে কীভাবে আমরা কাজ করব, কোন বিষয়গুলো খেয়াল রাখব, আমলে নেব আর কোন জিনিসগুলোকে পাত্তা দেব না। ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেব। বইটি যেহেতু আত্মন্নোয়নেক ফলে নিজেকে আরো নিখুঁত করতে সাহায্য করবে বইটি, অন্য একটা মানুষকে কীভাবে গ্রহণ করতে হয়, একমত না হলেও কীভাবে সম্মান দেখাতে হয় সবই জানা যাবে। আবার ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি আমি কেমন আচরণ করছি সেটা যাচাইয়ের সুযোগ আছে। নিজের আবেগ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার বিবেচনা করার সহজ সূত্রগুলো দেয়া হয়েছে। যেগুলো পড়ে কাজ করলে ধীরে ধীরে নিজের সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশ সম্ভব।
আমরা অনেক সময় নতুন কারও সাথে পরিচিত হতে চাই বা এমন কোনো একটা পরিস্থতিতে পড়ে যাই যে, আলাপ না করে কোনো উপায়ই থাকে না। কিন্তু দেখা যায় কীভাবে আলাপটা শুরু করব, বুঝে উঠতে পারি না। এখানে বেশকিছু নমুনা আলাপচারিতা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বাস্তব জীবনে অনুশীলন করলে দক্ষতা বাড়বে বলে আশা করা যায়। একটা অধ্যায় আছে চাকরি করব না দেব, সেখানে উদ্যোক্তা হবার জন্য কী কী মানসিক দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা জরুরি সে সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছে। এমনকি বিখ্যাত সব উদ্যোক্তাদের একটা ছোট তালিকা ছবিসহ দেয়া আছে, যেটা তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করবে। তরুণ প্রজন্মের লক্ষ্য করেই নিউ মিডিয়ার কিছু খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু খুব সংক্ষেপন তুলে আনা হয়েছে। লেখকদ্বয় হয়তো ভেবেছেন যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতেই হলে প্রযুক্তিকে পাশ কাটিয়ে সেটি সম্ভব না। কারণ তথ্য প্রযুক্তি এখন আমাদের জীবনাচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
ছবি, গ্রাফ এবং কমিকসের ব্যবহারই বলে দেয় বইটি বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে মাথায় রেখে করা। কাগজের প্লেন দিয়ে সুন্দর প্রচ্ছদটির শিল্পী সায়মন জাকারিয়া। বইটির সম্পাদনা করেছে মধুপোক এবং প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ৪০০ টাকা।