ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সৃষ্ট-জগৎ

সন্দীপন ধর
🕐 ৪:২৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩০, ২০২০

হারুন পাশা সম্পাদিত ‘পাতাদের সংসার’ হাবীবুল্লাহ সিরাজী সংখ্যাটি পড়া শেষ করে প্রথমত যে কথাটি বলতে হয়, বাংলা ভাষার বিশাল কাব্যভাণ্ডারে দৃষ্টি দিলে যার নাম স্বতন্ত্র ঔজ্জ্বল্যে দ্যুতি ছড়ায়, তিনি ষাটের দশকের অন্যতম কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তার কবিতায় মনোযোগী হলেই বোঝা যায়, নিজেকে তিনি বারবার কী কৌশলে পরিবর্তন করেছেন; তার কবিতার বুনন, ভাষাশৈলী থেকে উপস্থাপন, এমনকি তার কবিতার বিষয় নির্বাচন এবং তার পরিবর্তন আমাকে চমকিত করে। কবিতার নিরবচ্ছিন্ন সচেতন নির্মিতি প্রত্যক্ষ করতে অনুসন্ধিৎসু পাঠককে কবির শরণাপন্ন হতে হবে। যেমন তার পাঠককে চমকে দেওয়ার মতো কাব্যমেধা আছে, পাশাপাশি কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের কবিতাকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্যও তার মধ্যে অপরিসীম। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার উচ্চতা তার সময়ের অন্য অনেক কবির চেয়েই স্বতন্ত্র। আমার ধারণা, তার এ স্বাতন্ত্র্যের কারণে অনেক সমালোচক হয়তো তাকে এড়িয়ে যান; কবিতার গভীর সৌন্দর্য আবিষ্কারের জন্য যে প্রস্তুতি একজন সমালোচকের থাকা প্রয়োজন তেমন সামর্থ্যে পৌঁছানোর আগেই অনেকে গদ্য রচনার কসরত শুরু করেন; বোধগম্য কারণেই অনেক ক্ষেত্রে হাবীবুল্লাহ সিরাজী অনালোচিত থেকে যান। এমনকি আমি নিজেও মনে করি, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যালোচনার জন্য আমিও আদৌ যোগ্য নই। তবে হারুন পাশা তার সম্পাদিত পাতাদের সংসার হাবীবুল্লাহ সিরাজী সংখ্যায় অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছেন বিভিন্ন আলোচকদের মাধ্যমে।

এ সংখ্যায় আলোচক মজিদ মাহমুদ উল্লেখ করেছেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী সহজ পথের কবি নন। তার সঙ্গে একমত। হাবিবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা বুঝতে গেলে বক্তব্যগুলোকে অনুধাবন করতে হবে। কারণ তার কবিতাজুড়ে চলে দ্বিরুক্তি বদভ্যাসের খেলা। তার কবিতার যেমন স্বদেশের সমসাময়িক বিভিন্ন আলোচিত বিষয়কে তুলে ধরেছেন, আবার অনেক সময় দেখা যায় বিশ্বদরবারের বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন।

সিরাজী কবিতায় নগর ও গ্রাম জীবনের বাস্তবতা যেমন দেখিয়েছেন, আবার পাশাপাশি রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্রমপরিবর্তন, ক্ষমতা কাঠামোর রূপ-রূপান্তর, নাগরিক ক্লেদ-ক্লান্তি-অবসাদ-সংগ্রাম-স্বপ্ন, বৈশ্বিক প্রভাব ও প্রযুক্তির আমদানি দেখিয়েছেন, আবার একই সঙ্গে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রূপ বদলের অন্তর্বয়ন বাংলাদেশের কবিতাকে নতুন বিষয়-আশয় ও প্রকরণের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটিয়েছেন।

সংখ্যাটিতে আলোচকদের প্রবন্ধগুলো পড়ে যেটা আমার উপলব্ধি, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার পরিমিতিবোধ, বুননরীতি, শব্দচয়নে স্বাতন্ত্র্য, নির্মাণশৈলীর কুশলী গ্রন্থনা, ছন্দবিন্যাস নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি দৃশ্যের অধিক বাক্সময় করার মুন্সিয়ানা ইত্যাদি অনুষঙ্গের কথা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিল।

অচেনা ভুবনে ভ্রমণের আগে সেখানকার আবহাওয়া-জলবায়ু-পরিবেশ-পারিপার্শ্ব যেমন জেনে নেওয়া আবশ্যক; এও অনেকটা তেমনি। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সহজ-সরল ভাষায় কাব্যচর্চা করেন না। সুতরাং যেখানে আড়াল থাকবে, সেখানে উন্মোচনের প্রচেষ্টাও থাকতে হবে; যখন বিমূর্ততার ঘোমটা থাকবে তখন অন্তরালোকে মূর্ত করে নেওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে; যখন গতির ক্ষিপ্রতা থাকবে, সে ক্ষিপ্রতাকে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গৌরব অর্জনের প্রয়োজন হবে। জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের আনন্দ সহজপ্রাপ্য হবে তেমনটি আশা করাও অন্যায়।

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্য পাঠের মাধ্যমে পাঠকের মস্তিষ্কের গ্রন্থগুলো সজাগ রাখার পাশাপাশি হৃদয়ের কপাটগুলোকে শিথিল করে দেয়। হৃদয়সংবেদি পাঠে উন্মোচিত হয় দুর্ভেদ্য সব অন্ধকার। এ সংখ্যায় প্রাবন্ধিক স্নিগ্ধা বাউল তার লেখার মাধ্যমে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়েছেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী যেকোনো তুচ্ছ বিষয়কে কবিতা করে তুলতে সিদ্ধহস্ত। বাংলা ভাষার আরেক প্রকৌশলী কবি বিনয় মজুমদারের কবিতায় সাধারণকে অসাধারণ করে তোলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কেবল বিনয় মজুমদার নন, অনেক বড় কবির কবিতায় গুণটি দেখা গেছে। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখায়। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতায় এই প্রবণতাটি যেন স্বতোৎসারিত। হাবীবুল্লাহ সিরাজী কবিতার কবিরাজ; উপশমের মাত্রায় রচনা করতে চেয়েছেন বেদনার সমাপ্তি।

উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক-ইঙ্গিতের মাধ্যমে কবিতাকে কখনো এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যার গ্রন্থি সাধারণ পাঠে উন্মোচিত হওয়ার নয়। যে কারণে তার কবিতা বারবার পাঠের প্রয়োজন পড়ে; কবিতা যে অমনোযোগী পাঠের অনুষঙ্গ নয়, কবিতায় অন্তরপ্রবাহ বিদ্যমান; কবিতায় সে গোপন-অদৃশ্য সৌন্দর্য বিদ্যমান, এসব সত্য হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা পাঠে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। তেমন ব্যঞ্জনার কবিতা তার কবিতা থেকে সহজেই উদ্ধার করা যাবে। কবিতায় কেবল দেশ-কাল সমকালীন রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কথাই তুলে ধরেননি, তার প্রেমের কবিতায় তিনি প্রতীক-ইঙ্গিত এবং আড়ালের আশ্রয় নিয়েছেন, সে কথাও উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধের মাধ্যমে, এ সংখ্যায়। কবি আসাদ চৌধুরীর লেখাটি পড়লেই সেটি পাঠকের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে সূর্যের আলোর মতো। তিনি লিখেছেন ‘...তিনি নিজেকে প্রকাশ করেও ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তার ভাবনা-চিন্তা, কল্পনা-অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস-ঘূর্ণন, আবেগ-অনুভূতি পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।’ তিনি যে বিজ্ঞানের প্রকৃত ছাত্র, সেটি পরিষ্কার হয় মিল্টন বিশ্বাসের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারটি পড়লেই।

যেখানে সহজ কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্মিলিত রূপই হলো সাহিত্য কিংবা তার আত্মজীবনী ‘আমার কুমার’ গ্রন্থটি পাঠ করলেই সেটি আরও ভালো করে উপলব্ধি করা যায় অথবা বইটি নিয়ে এ সংখ্যায় রফিকুর রশীদ ও পিয়াস মজিদের প্রবন্ধটি পাঠ করলেই আমার মনে হয় যথেষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। যদিও কবিতার পাশাপাশি তার ঘোরাফেরা কথাসাহিত্য ও গদ্যেও। কিন্তু এ বিষয় এতকাল আমার যদিও তেমন পড়া নেই, তবু এ সংখ্যায় সেইসব দিকগুলো নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়ার পরে আগামীদিনের আগ্রহ রইল হাবীবুল্লাহ সিরাজীর উপন্যাস ও গদ্য পাঠের।

পাতাদের সংসার। সম্পাদক : হারুন পাশা
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রচ্ছদ : আল নোমান
মূল্য : ১০০ টাকা

 
Electronic Paper