ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রক্তিম অরুণোদয়

আহাদ আদনান
🕐 ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২০

‘বেলা হইয়া গেল বউ। মাছগুলা বাইন্ধা দাও’।
ভোররাতে খাল থেকে ধরা শিং আর কৈ মাছগুলো এখনও লাফাচ্ছে। দুইটা পাতিলে পানি দিয়ে মাছগুলো ভালো করে আটকে দিল আয়েশা বানু।
‘এই লও মাছ। সুন্দর কইরা জিয়াইয়া দিছি। লঞ্চে পাতিলের মুখটা একটু খোলা রাইখো। বোবা জান। বাতাস না পাইলে কইতেও পারব না। এক্কেরে ঢাকা যাইয়া বঙ্গবন্ধুর সামনে নিয়া দিবা। কইবা আনিসের মা খালের টাটকা মাছ রাসেল বাজানের লাগি পাঠাইছে। আর ফরিদপুরের সবচেয়ে খাঁটি খেজুরের গুড় দিয়া চিড়ার মোয়া দিছে ভাবির লাগি। কী, কইবা না?’
আবু মিয়া শুনে হাসে।

‘তোমার বুদ্ধি আর হইল না আনিসের মা। রাসেল বাজান খাইব মোয়া, আর ভাবি কুটব মাছ। কোনটা পোলাপান পছন্দ করে, আর কোনটা বড় মাইনষে এটাই কইতে পার না। আর তোমার কথা কইলে চিনব হেরা? তিনি হইলেন জাতির পিতা। সারা দেশের মাথা। এই কোটালিপাড়ায় আমরা তার কত দূরের মামাত ভাই। একবার আইছিল বিয়ার সময়। পনের বছর আগের কথা। আমারেই চিনে কিনা কইতে পারি না, আবার আনিসের মা!’
‘এটা তুমি ভুল কইলা। সক্কলে কী কয় তুমি জানো? বঙ্গবন্ধু সবার নাম মুখস্ত কইরা রাখে। একবার মনে রাখলে জীবনে ভুলে না। তুমি একবার খালি তার সামনে দাঁড়াও। তোমার নাম ধইরা যদি না ডাকে...।’
‘অইছে, অইছে। আমার এখন বাইর হইতে হবে। ট্রলারে কইরা যাব পয়সার হাট। এখন না বাইর হইলে লঞ্চ ছুইটা যাইব।’
‘লঞ্চ কহন ছাড়ব?’
‘কেন, সন্ধ্যায়। আজ ১৪ আগস্ট। ঝড় বাদলা না হইলে কাল, মানে ১৫ আগস্ট সদরঘাট নাইমা যামু।’
‘কাইল তো শুক্রবার। জুম্মা পইড়া লইয়ো?’
‘আনিস বাজান, বাড়ি থেকে বাইর হবি না। আম্মার যা লাগে কইরা দিবি। আর কাইল জুম্মার আগে আগে মসজিদে যাইয়া মোল্লারে কবি, বাজান ঢাকা গেছে বঙ্গবন্ধুর লগে দেহা করতে। বঙ্গবন্ধুর আর আমার লাইগা দোয়া করতে কবি। আমি অবশ্য কইয়া দিছি, তুই শুধু মনে কইরা দিবি’।
অশ্রুভেজা বিদায় শেষে আবু মিয়া বের হয়ে পড়ে। অনেকদিন পর আজ সে ঢাকা যাবে। কিছুটা ভয় হচ্ছে কি? নাকি উত্তেজনা? দেশ এখন স্বাধীন। তার মুজিব ভাই এখন জাতির পিতা। তার বাড়িতে যাচ্ছে আবু মিয়া। এই উত্তেজনা লুকিয়ে রাখা কঠিন না, অসম্ভব।
‘আবু ভাই, নতুন পাঞ্জাবি মনে হয়? কই মেলা দিলা? পাতিলে কি মাছ জিয়াইছ? কুটুম বাড়ি? পোলার বিয়া ঠিক করতে যাও নাকি?’
‘কী যে কও? এইটা কি রূপবানের যুগ যে বারো বছরের পোলার বিয়া দিমু। যাইতাছি ঢাকা। বঙ্গবন্ধুর লগে দেহা করুম।’
আবু মিয়ার কথা শুনে ট্রলারের সবাই নড়েচড়ে বসে। বারবার তাকায় ওর দিকে। কথার পসরা সাজায় যাত্রীরা।
‘তুমি ঢাকা চিনো নাকি? সদরঘাটেই তো হারাইয়া যাইবা?’
‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ি তুমি যাইবা কেমনে? সে এখন দেশের রাজা। তোমার মতো প্রজারে ঢুকতে দিব?’
‘আবু ভাই, শেখ সাব’রে আমার সালাম দিও। কইও, শুক্কুর মৃধা আপনের লগে দেহা করতে আইতে চায়। রোজ রাইতে আপনের কথা মনে কইরা কান্দে। কালকিনির যুদ্ধে পা’টা যদি না যাইত...।’
থেমে যায় কথা। শুক্কুর মৃধার বাকি একটা পা আর কাঠের তক্তা যেন অনেক কথাই মনে করিয়ে দেয়। ট্রলারের লোকগুলো চলে যায় চার বছর আগে। পঁচাত্তর থেকে একাত্তর।
আলেক মিয়ার মনে পড়ে তার বাপ আর চাচার কথা। যুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেনি তারা।
গোপালের চোখ ভিজে আসে চন্দ্রর আর্তনাদের কথা মনে করে। ষোল বছরের মেয়েটাকে ধরে নিয়ে যায় হানাদারের দল। বাড়িটা দেয় পুড়িয়ে। কিছুই করতে পারেনি সে। তার হয়ত বেঁচে থাকারই কথা না। তবু কেমন করে বেঁচে আছে?
রমিজের চোখের সামনে তার দুই ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে জানোয়ারের বাহিনী। শফিক যুদ্ধ শেষে এসে শুনেছে, তার স্ত্রীকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে ওরা। তিন বছরের মেয়েটার বুকে বুট দিয়ে পিষে ফেলেছে হায়েনার দল।
আবু মিয়ার পায়েও গুলি লেগেছিল। সেটা বের হয়ে যাওয়াতেই রক্ষা। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটলেও কাজ করে খেতে পারে সে। এমন সৌভাগ্য সবার হয় কি?
পয়সার হাট লঞ্চ ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে আবু মিয়া। লঞ্চটা আজ দেরি করছে ছাড়তে? হঠাৎ করে তার মেজাজ বিগড়ে গেছে। সেটার কারণ আরজ আলী। বঙ্গবন্ধুকে বলে একটা বিহিত করতেই হবে।
মাঝরাত। আবু মিয়ার ঘুম আসছে না। একটা ছেলে দশ বারো বছর হবে হয়ত, আনিসের মতোই চেহারার ছাট, দাঁড়িয়ে আছে ডেকের এক কোনায়। নদী দেখছে? নাকি আকাশের তারা গুনছে সে? তারা তো নেই আজ। তাহলে?
‘বাজান, খাড়ায়া কী কর? ঘুমাও গিয়া। গাঙের বাতাসে ঠা-া লাগব।’
ছেলেটা কিছু বলছে না। চাঁদ নেই আজ। কিছু দেখাও যাচ্ছে না। বাতাস বাঁচিয়ে কায়দা করে বিড়ি জ্বালানোর জন্য দেশলাই ধরাতে গিয়ে আবু মিয়া দেখে ফেলে ছেলেটার চোখের জল।
‘কান্দ কেন বাজান। মা কই? তোমার বাপ কই?’ বলে জড়িয়ে ধরতেই ছেলেটা হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
‘আমার বাপ নাই। বাপ-মা কেও নাই। আমি পলাইয়া আইছি লঞ্চে’।
‘কেও নাই? তাইলে তুমি থাকোটা কই’?
‘থাকতাম মামুগো বাড়িত। মামু-মামি সারাদিন বকে।’
‘তোমার বাপ-মা মইরা গেছে?’
‘বাজান যুদ্ধে গেছিল শ্রাবণ মাসে। আর ফিরা আসে নাই। লোকেরা কয় আরজ রাজাকার বাজানরে ধরাইয়া দিছে। বাজানের লাশ গাঙে ভাসাইয়া দিছে। আর মা...।’
‘কী অইছে তোমার মার? সেও নাই?’
‘মামু জোর কইরা মায়ের বিয়া ঠিক করছে। আইজ দুপুরে বিয়া হইছে। আমার মা নাই। মইরা গেছে আমার মা।’ রাত শেষ হয়ে আসছে। একটু পরে ফজরের আজান পড়বে বোধহয়। ছেলেটাকে জড়িয়ে ডেকের এক কোনায় বসে আছে আবু মিয়া। সে ঠিক করেছে ওকে নিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। বলবে এটা আনিসের ভাই। বঙ্গবন্ধু এখন জাতির পিতা। নির্যাতিতা, ধর্ষিতা, অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারিণীদেরও পিতা। আবু মিয়াও না হয় দেশের একজন অসহায়ের সহায় হবে। বঙ্গবন্ধু শুনলে কি খুশি হবেন না? আবু মিয়া গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। সে মূর্খ, গেঁয়ো। তবে তারও ক্ষোভ আছে। সে বিচার চাইবে বঙ্গবন্ধুর কাছে। অনেক কথা বলার আছে। অনেক কথা।
আরজ আলী ছিল কুখ্যাত রাজাকার। একাত্তরের ডিসেম্বরে সে ধরা পড়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে। কত মুক্তিযোদ্ধাকে সে ধরিয়ে দিয়েছে, খুন করেছে। কত মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। হিন্দুদের বাড়ি লুট করেছে। ধরা পড়ার পর সবাই ঠিক করল ওকে গুলি করে হত্যা করা হবে। পায়ে ধরে, কান্নাকাটি করে কীভাবে যেন কমান্ডার সাহেবের মন নরম করে ফেলল। ১৬ ডিসেম্বর যখন একটা পতাকা হাতে, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিতে দিতে মিছিলে মিশে গেল, কেউ যেন খেয়ালই করেনি। এখন সে নেতা। সরকারি দলে যোগ দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলে। আবু মিয়া ঠিক করে বঙ্গবন্ধুকে সে বলবে এসব কথা। ‘মুজিব ভাই, এই রকম শ’য়ে শ’য়ে আরজ আলী এখন দলে ভিড় করছে। এরা এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ করবার ছক কষতাছে। এখনও মহিলাদের নির্যাতনের সুযোগ খুঁজতাছে। রিলিফের টাকা, ভাতার টাকা, ত্রাণ, কম্বল সব লোপাট করে দিতাছে। এদের ঠেকান মুজিব ভাই। না হইলে এই সূচগুলান ফাল হইয়া আপনারেই শেষ করে দিব। আমাদের শেষ করে দিব। বাংলাদেশটারে শেষ করে দিব।’
ফজরের আজান ভেসে আসে। ছেলেটা ঘুমিয়ে গেছে। আবু মিয়া জীবনে কখনও ফজর পড়ে ঘুমায়নি। কিন্তু আজ নামাজটা পড়ার পর চোখ কেন জানি ঢলে আসছে তার। নতুন পাওয়া ছেলেটাকে জড়িয়ে ডেকে শুয়ে পড়ে সে। আচ্ছা, বঙ্গবন্ধু এখন কী করছেন? ফজরের নামাজ পড়ে কি কোরআন পড়েন মুজিব ভাই? ভাবি এসে চা করে দেন? নাকি রেহানা, হাসিনা ওরা চা করে দেয়? মেয়েগুলো নাকি এখন বিদেশে আছে। পড়ালেখা করতে গেছে। চা দোকানের মকবুল রেডিওতে শুনেছে। আজ তো ১৫ তারিখ। ১৫ আগস্ট। শুক্রবার। মুজিবা ভাই জুম্মা পড়েন কোন মসজিদে?
‘আবু নাকি? তোরে তো দেখাই যায় না আজকাল। করিস কী আজকাল?’
‘মুজিব ভাই, আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন? ভাবি কই? রাসেল বাজান কই?’
‘এই দেখে যাও, পাগলটা কী নিয়ে এসেছে। কী মাছ এনেছিস? নিশ্চয়ই শিং আর কৈ?’
‘আপনি না দেখেই বলে দিলেন ভাইজান?’ ‘হা হা, দেশটা কে চালায়, আমি নাকি তুই? আমি সব জানি, সব বুঝি। শুধু আমার দুঃখটা তোরা বুঝলি না।’
‘আবু ভাই, কেমন আছেন? আনিসের মা কেমন আছে? কত দূর থেকে এসেছেন, নিন, শরবতটা খান।’
‘ভাবি, এটা কি খাওয়ালেন? এমন মধুর শরবত আমি জীবনে খাইনি। আর আপনাদের বাড়িতে কি ফুলের বাগান আছে? কি মিষ্টি সুবাস। খোদার কসম, এমন মিষ্টি সুবাস এই জন্মে আমি পাইনি।’
‘পাবিও না। এটা বেহেশতি ফুল। এই ঘ্রাণ তোদের মাটির দুনিয়াতে পাবি না। এই শরবতও স্বর্গের ঝর্ণার নহর থেকে আনা। আমি তো এখন বেহেশতে। আসবি নাকি। এইখানে কোনো দুঃখ নেই। অভাব নেই। অশান্তি নেই। বিশ্বাসঘাতকতা নেই। আইসা পড় একেবারে।’
আবু মিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। তার চোখ ভিজে গেছে। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন সে জীবনে দেখেনি। নদীর সুশীতল হাওয়াও সেই স্বপ্নের স্বর্গীয় সুবাসকে ভুলিয়ে দিতে পারছে না। ছেলেটা এখনও ঘুমাচ্ছে। ঘড়িতে সাতটা বাজে। বঙ্গবন্ধু এখন কী করছেন? তিনি ভালো আছেন তো? কোনও অসুখ বিসুখ হয়নি তো? স্বপ্ন তো স্বপ্নই। আবু মিয়া স্বপ্নটা ভুলে ১৫ তারিখের বাংলার লাল সূর্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কেন জানি মনে হচ্ছে, সূর্যটার বুক থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। সূর্যের আলো না, বরং লাল লাল রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে।

 
Electronic Paper