অহি-নকুল কথকতা
চিরঞ্জীব সরকার
🕐 ৬:২৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৫, ২০২২

আমি যখন ছোটকালে গাছপালা বা ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর হেঁটে হেঁটে নিঃশব্দে আমার একান্তই নিজস্ব একটা বনচারী জগতে বিচরণ করতাম। তখন নানা ধরনের চেনা অচেনা লতা-গুল্ম, পুষ্প, বৃক্ষ এদের সান্নিধ্যে আসতাম। এগুলোকে আমি স্পর্শ করতাম, ঘ্রাণ নিতাম, অবাক বিস্ময়ে এদের সৌন্দর্য উপভোগ করতাম।
পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশের লেখার সাথে যখন পরিচয় ঘটে; তখন দেখি তিনি এগুলোর অনেকটাই তার লেখায় স্থান দিয়েছেন যেমন ডুমুর, হিজল, অশ্বত্থ, কলমির দাম, মুথা ঘাস, ভাঁটফুল, শটিবন, ফণিমনসা, আকন্দ, ধুন্দুল ইত্যাদি আরো কত কিছু। বাড়ির উত্তর দিকে মোটামুটি আধো জঙ্গল বলা যায় এ জায়গাটায় ফুটত ভাঁটফুল।এর একটা চমৎকার সুঘ্রাণ আছে।এ ফুলগুলোতে ছিল অনেক কালো কালো ছোট পিঁপড়েদের অবাধ বিচরণ।
তাই ভাঁটফুল তোলার সময় পিঁপড়ের মৃদু দংশন সহ্য করতে হত। কিন্তু ফুলগুলো তোলার পর বেশ ভাল লাগত। আর পিঁপড়ের কামড়কে মেনে নিতাম এটা ভেবে যে, ’কাটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে/দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?’ কমল করায়ত্ত করতে মৃদু কণ্টকের খোঁচা কি কখনো কোনো বড় প্রতিবন্ধক হতে পারে?
একদিন সকালে যখন এদিকটা দিয়ে হাঁটছিলাম তখন দেখি জঙ্গলটার ভিতর অনেক ভাঁটফুল ফুটে রয়েছে। ইচ্ছে হল কিছু ফুল তুলে আনি। যখন ওদিকটায় যাব তখন খেয়াল করলাম ফুলের গাছগুলি কেন যেন দুলছে। বুঝতে পারলাম নীচে হয়ত কোন প্রাণী নড়াচড়া করছে। ভয় পেয়ে সরে এসে অন্য আর এক দিক থেকে ঘুরে এসে দেখতে চেষ্টা করলাম আসলে ওখানে কি ঘটছে। দেখলাম তা হল একটা সাপ ও বেজির ভিতর যুদ্ধ চলছে। সাপটি ফনা তুলে বেজিটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে চলেছে কোনো প্রকার নড়াচড়া ছাড়াই। বেজিটি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছোটাছুটি করে সাপটিকে আক্রমণের চেষ্টা করছে।
পাঠ্যপুস্তকে অহি(সর্প) নকুল (বেজি) সম্পর্কের কথা পড়েছি।এখন এ সম্পর্কটা বাস্তবে কেমন তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। বেজিটিকে ধন্যবাদ, ওর ছোটাছুটির কারনেই এ ভাঁটফুলের ঝোপে প্রবেশ করিনি, করলে হয়ত এখানে অপেক্ষারত নাগরাজ কর্তৃক আমার বড় সর্বনাশ হয়ে যেতে পারত। তারাপদ রায় ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’ কবিতাটিতে বলেছেন, ‘আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম/যার উদ্দেশ্যে ধ্রুপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম/ গতকাল বলাই বাবু বললেন- ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ।’ এ কবিতাটির মত তখন হয়ত আফসোস করে আমাকেও বলতে হত, ‘এ হাত দিয়ে এখানে বনফুল তুলতে এসে শেষ পর্যন্ত ফুলের বদলে পটলই তুলে ফেললাম’।
সাপ ও বেজিটির সংঘর্ষ শেষ হচ্ছে না। কেউ কাউকে দৃশ্যত পরাস্ত করতে পারছিল না। এ অবস্থায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে কিনা সেটা চিন্তা করতে লাগলাম।দুটোই একটা লড়াইয়ের মাঝে আছে।মানে দুজনেরি মাথা এখন গরম। হুট করে এসে যদি এ দর্শককে কামড় বসিয়ে দেয় তখনতো আর কিছু করার থাকবে না। আবার লড়াইটার শেষ পরিনতি না দেখা পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করতেও ইচ্ছে হল না। ইচ্ছে করলে আমি দুএকটা ইট ওদের দিকে ছুড়ে মেরে এ লড়াইটা ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারতাম। কিন্তু কিশোর বয়সের আবেগ ও উত্তেজনা এ কাজটি করা থেকে আমাকে বিরত রাখল। তাছাড়াও বেজি কর্তৃক সর্পটি হত হলে স্থানটা নিরাপদ হবে। এহেন চিন্তা থেকে আমি বরং নিরাপদ দূরত্ব হিসেবে নিকটস্থ একটি দেশি বড়ই গাছে আরোহণ করে ওদের ফাইটিং পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম।
আমি নিশ্চিত ছিলাম এ যুদ্ধে বেজিটিই জয়লাভ করবে তার গতি ও কৌশলের কারণে। সাপটি একটি জায়গাতেই স্থির হয়ে আছে। বেজিটি কিন্তু দেখছে কেনো মুহূর্তে তাকে আক্রমণ করলে সে কুপোকাৎ হবে। সাপটির একটু যদি মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটে তবে সে আর নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে না। জীববিজ্ঞানে সিমবায়োসিস বা মিথোজীবিতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে যখন দুটি ভিন্ন প্রজাতির জীব একত্রে নিবিড়ভাবে বসবাস করে একটি অপরটির দ্বারা উপকৃত হয় তখন এ ঘটনাটাই হলো মিথোজীবিতা। কিন্তু যখন দুটি প্রজাতির জীব সাক্ষাতমাত্রই লড়াই শুরু করে দেয় এবং একটির ঘাড় কামড়ে শেষ করে দেয়া পর্যন্ত সে লড়াইয়ে ক্ষান্ত হয় না তাকে যে কি বলে তা তা এখনো জানা হয়নি। তবে এরকম ঘটনাকে অহি-নকুলতা নাম দিলেও দেওয়া যেতে পারে।
আর একটা সম্পর্কও খুব মারাত্মক সেটা হল দা-কুমড়ো সম্পর্ক। তবে এ সম্পর্কটা অহি-নকুল সম্পর্ক থেকে কম মারাত্মক ঘাতকতার বিচারে। কুমড়ো কাটার প্রয়োজন হলেই কেবলমাত্র কুমড়োর উপর দায়ের প্রয়োগ হয়। আমি নিজেও যখন বিভিন্ন বাজার থেকে কুমড়োর ফালি কিনি তখন লক্ষ্য করেছি বিক্রেতার কাছে যতগুলো কুমড়ো মজুদ থাকে তার ভিতর দু’একটি কুমড়োই কেবল ফালি ফালি করে কেটে সাজিয়ে রাখা হয়। বাকি কুমড়োরা দায়ের কোপ থেকে অক্ষতই থেকে যায় সাময়িকভাবে। কিন্তু সাপ ও বেজি যেকোন সংখ্যায়ই তারা থাকুক না কেন সাক্ষাতে তাদের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের মরনঘাতী লড়াই অবশ্যম্ভাবী। দুটো প্রাণীরই জেনেটিক কোডে এ লড়াইয়ের সংকেতটা হয়ত দেওয়া রয়েছে।
এ লড়াইটা শেষ পর্যন্ত আমি আর দেখতে পারলাম না। কারণটা হল সাপটিকে দেখলাম স্থবিরতা ভঙ্গ করে হঠাৎ সে বড়ই গাছটির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। বেজিটিও তার গতিপথ বদল করে ফেলল। বড়ই গাছের উপর থেকে আমার সাথেও তার চোখাচোখি হল। এখন সাপটি যদি প্রাণ বাঁচাতে এ গাছটিতে উঠে যায় তবে বেজিটিও নিশ্চিত তার পশ্চাৎধাবন করে এখানে উঠে আসবে।
সাপ ও বেজি দুটোই বৃক্ষে আরোহনে পারদর্শী। তবে এক্ষেত্রে যদি অলিম্পিকের গোল্ড মেডেল দেওয়া হয় তবে যোগ্যতার বিচারে সেটা পাবে কাঠবিড়ালী।এত দ্রুততার সাথে সে এক গাছ থেকে আর এক গাছে জাম্প করতে পারে তা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এমনকি গাছের পাতার উপরও সে দৌড়াতে সক্ষম পাতাটিকে অক্ষত রেখেই।
এ্যাডভেঞ্চার ছেড়ে বড়ই গাছটি থেকে লাফ দিয়ে নেমে দ্রুত ওই স্থান ছেড়ে এলাম। তবে এ ঘটনার পর থেকে আগের মত আর কোনো কিছু না ভেবে কোনো জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে প্রবেশ করতাম না। অবচেতন মনে মনে হত এখানে বুঝি কোন সাপ লুকিয়ে আছে। কিন্তু এখন মনে হয় পৃথিবীর প্রতিটি স্থানেই বিপদ লুকিয়ে আছে যা মুহূর্তেই তছনছ করে দিতে পারে আমাদের মনের বাগানে সাজানো স্বপ্নের ফুলগুলিকে।ঝর্নায় অবগাহন করে ফিরে আসা ছেলেগুলো কি স্বপ্নেও ভেবেছিল একটু পরেই প্রাণ নিভে যাওয়ার মত একটি বিপদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে একটি সড়ক ও রেলপথের সংযোগস্থলে।
