আমার মা। অপরিমেয় প্রসব-বেদনার মধ্য দিয়ে জন্ম দিয়েছেন সাত সাতটি সন্তান। প্রতিবারেই তিনি হয়েছেন রক্তাক্ত। আর আমরা বড় হয়ে উঠেছি তাঁর রক্তের উর্বরতায়। বড় হয়ে উঠার সমান্তরালে বড় হতে লাগল আমাদেরকে নিয়ে মায়ের রক্ত-নির্মিত স্বপ্নগুলোও। ‘তোরা বড় হ, মানুষের মতো মানুষ হ’-আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় তাঁর চোখ থেকে যে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ত, এই ছিল তাঁর সহজ অনুবাদ। আমরা বড় হলাম। ছড়িয়ে পড়লাম এদিক-সেদিক। বড় একা হয়ে গেলেন মা! নিঃসঙ্গতার যাত্রাপথে স্বপ্নই তাঁকে শক্তি জোগাতে লাগল প্রতিনিয়ত। আমাদের নিয়ে তৈরি স্বপ্ন। তিনি জানেন- তাঁর কিছুই নেই। কিন্তু রক্তের যে ঋণ আর বুক ভরা যে ভালোবাসা আছে, তা-ই তাঁকে স্বপ্ন দেখায়। তাঁর স্বপ্নের ঠিকানায় আমরাই যেন এক একজন ‘ডাক-পিয়ন’।
সময় বয়ে চলল। শুরু হল সত্যিকারের ‘বড়’ হবার প্রতিযোগিতা। অর্থ, স্বার্থ আর ক্ষমতার মিশ্রণে তৈরি হতে থাকল আমাদের মন এবং মানসিকতার বায়োডাটা। উৎপাদিত হল দ্বন্দ্ব, সংঘাত এবং সংঘর্ষের কুণ্ডলী। মাকে কে কতটুকু দিয়েছি- এই নিয়ে হিসেবী-বিতর্ক। আসলে আমরা কেউই কিছু দিতে পারিনি। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে মাকে দেখতে আসি। মাতৃ-ভক্তির পারদ হঠাৎ করেই কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। খানিক পরেই যে যার জায়গায় ফিরে যাই- হাজারো আশ্বাস আর সম্ভাবনার কথা বলে। একটুও বদলাননি মা। যাওয়ার সময় সেই আগের মতো আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এবারও দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, এবারও তাতে খুঁজে পাওয়া গেল স্বপ্নের সজীব রূপায়ণ।
একই মায়ের রক্ত আমাদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত। একই মায়ের বুকের দুধে নির্মিত আমাদের দৈহিক ‘মানচিত্র’। তবু আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে স্বার্থের দেয়াল। আমরা একই মায়ের সন্তান- এই পরিচিতি আজ পরাজিত। মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধের জায়গাটিতে স্থান পেয়েছে নিজেদের আখের গোছানোর উন্মাদনা। আমরা আস্তে আস্তে মাকে ভুলতে বসলাম। ভুলে গেলাম রক্তের বাঁধন। সাতজনই একে অপরের মুখোমুখি।
টের পেয়ে যান মা। শুরু হয় হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমাদের অনৈক্য আর স্বার্থের দ্বন্দ্ব ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয় তাঁর স্বপ্ন আঁকার তুলিটিকে। বড় ক্লান্ত মা। কী চেয়েছিলেন আর কী পেলেন!
হঠাৎ মায়ের অসুস্থতার খবর পাই। সবাই ছুটে গেলাম। দায়িত্ববোধের কিংবা ভালোবাসার টানে নয়; সামাজিকতার নিয়ম রক্ষায়। আমাদের চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়ে মা বুঝে ফেললেন- এ শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। তবুও মা! আমাদের কাছে পেয়ে খুশি হয়ে উঠলেন। আবারো আমাদের মাথায় হাত বুলালেন। কোনো অভিমান নেই। আবারো অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আবারো ধ্বণিত হলো স্বপ্নের অনুরণন। একটুও বদলাননি মা! আমরা ভাবি- মায়ের এই না-বদলানোটাও কি আমাদের বদলাতে পারে না?
প্রিয় বাংলাদেশ, তুমি-ই তো আমাদের মা! তুমি তো একটুও বদলাওনি। আমাদের দ্বারা সৃষ্ট হাজারো দুঃখ-কষ্ট বেদনার পরেও অপরিসীম মায়া-মমতা ভালোবাসা দিয়ে আমাদের লালন করে চলেছো। এবার আমরা কি একটু বদলাতে পারি না?
(জানুয়ারি, ২০০৯)
কেকে/এএম