জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিপক্ষকেও পরাজিত করে যে বিজয় মুকুট অর্জন করা যায় তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ মাগুরার শালিখা উপজেলা বুনাগাতী ইউনিয়নের বাউলিয়া গ্রামের সাধন রায়ের মেয়ে প্রিয়াংকা রায়।
প্রিয়াংকা রায় শালিখা উপজেলার বাউলিয়া গ্রামের সাধন রায় ও সেফালী দম্পত্তির কনিষ্ঠ কন্যা। ২০১২ সালে নিজ গ্রামের বাউলিয়া নীরদকৃষ্ণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৪ সালে যশোর সরকারি এমএম কলেজ থেকে এইসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে।
যবিপ্রবিতে অধ্যায়নকালে ২০১৯ সালের ৩ জুলাই ‘একিউট লিউকেমিয়াথ নামের নির্মম তথা মরণব্যাধি ক্যানসার তার জীবনকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। পরে ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে শুরু হয় কঠিন চিকিৎসার পথ। সাধারণ স্কুল শিক্ষক বাবার পক্ষে চিকিৎসার বিশাল ব্যয় বহন করা ছিল প্রায় অসম্ভব, তবুও বাবা হাল ছাড়েননি, আর সহপাঠীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা ছিল প্রিয়াংকার শক্তি। ৪ মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন তিনি।
চিকিৎসা শেষে আবারো মনোনিবেশ করেন লেখাপড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের বিভাগে একাধিক সেমিস্টারে নিখুঁত সিজিপিএ অর্থাৎ ৪ এর মধ্যে ৪ অর্জন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিভাগের সেরা। মৃত্যুঘাতী ব্লাড ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে তিনি শুধু বেঁচে ফিরে আসেননি, ছুঁয়ে ফেলেছেন নিজের বহু লালিত স্বপ্ন। ৪৫তম বিসিএসে কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ ক্যাডারে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন—ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাধাই অদম্য নয়।
হাসপাতালের বিছানা থেকে যে মেয়ে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছে, সেখান থেকেই তিনি শিখেছেন বেঁচে থাকা মানেই নতুন শুরু। চার মাসের তীব্র কষ্টকর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ফেরার পর তার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ ছিল স্ট্যাডি গ্যাপের কারণে প্রাপ্য সম্মানগুলো না পাওয়া। এই আক্ষেপই তাকে আরও দৃঢ় করেছে। যেভাবেই হোক, তাকে সেরা হতেই হবে।
কোনো কোচিং ছাড়াই শুধু নিজের প্রতিদিনের পরিশ্রম আর অবিচল বিশ্বাসের ওপর ভর করে তিনি শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। বিসিএসের প্রস্তুতির মধ্যেই তিনি আবার সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। প্রিলিমিনারি, লিখিতসহ সব ধাপ পেরিয়ে চাকরি করতে করতেই তিনি অংশ নেন ভাইভায়।
অবশেষে, সোনালী ব্যাংকের ইশ্বরদী শাখায় চাকরিরত অবস্থায় ৪৫তম বিসিএসের ফল যেদিন প্রকাশিত হলো—প্রিয়াংকা রায় নির্বাক হয়ে গেলেন। যে পরিবারের কাছে তার সুস্থ হয়ে ওঠাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, সেখানে ক্যাডার হওয়া যেন এক অতিরিক্ত অলৌকিক আনন্দ।
নিজের গল্প বলতে গিয়ে প্রিয়াংকা খোলা কাগজকে বলেন, “ক্যানসার থেকে বেঁচে ফিরেই বিশ্বাস হয়েছিল, আমি পারব। জীবন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে—সেই সুযোগকে আমার জেতার গল্পে পরিণত করতেই হয়েছিল।”
“অসুস্থতার মধ্যেও বই-নোট নিয়ে পড়াশোনা করেছি। পরিবারের অটুট সমর্থন, শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা ও নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিই পথে রেখেছিল”, এভাবে কঠিন সময়ের কথা জানান তিনি।
প্রিয়াংকার বাবা-মা সন্তানের এই অর্জনে আবেগাপ্লুত। তারা জানান, সমাজের মানুষের দোয়া ও সহায়তা ছাড়া এত বড় পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হতো না।
শিক্ষক ও বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন প্রিয়াংকার সাফল্যকে শালিখার গর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
অনেকেই বলেন, প্রিয়াংকা শুধু ক্যানসার জয় করেননি—হাজার তরুণ-তরুণীর জন্য সাহস ও স্বপ্নের বাতিঘর হয়ে উঠেছেন। ক্যানসারের অন্ধকার পেরিয়ে জীবনের আলো হাতে নেওয়া প্রিয়াংকার গল্প আজ অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের জন্য।
কেকে/এজে