বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫,
২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: আন্দোলনরত শিক্ষকরা কাজে না ফিরলে আইনি ব্যবস্থা      রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসিকে তফসিল দেওয়ার আহ্বান নাহিদের      খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে প্রধান উপদেষ্টা      অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করতে হবে : উপদেষ্টা ফরিদা      প্রবাসীরা ৬০ দিনের বেশি দেশে থাকলে ফোন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে      এভারকেয়ারের পাশে সেনা-বিমান বাহিনীর মহড়ায় বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ      শীত নিয়ে দুঃসংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর      
সাহিত্য
গল্প : তোফাজ্জলের দুশ্চিন্তাগুলি
আদিত্য আনাম
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫, ২:২৩ পিএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

বাদ-এশা, জানাজা শেষ করে কালিমা তাইয়্যেবা পড়তে পড়তে চারজন লোক লাশের খাটিয়া কাঁধে তুলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে রওনা দেয় কবরস্থানের দিকে। খাটিয়ার পিছনে আরো প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন মুসল্লি। সবাই দোয়া পড়তে পড়তে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে। 

খাটিয়ার ওপরে তোফাজ্জলের লাশ, খড়কুটোর মতো নিশ্চুপ আর নিথর হয়ে শুয়ে আছে। কিছুদূর যাওয়ার পর তোফাজ্জলের আত্মা তার লাশের ভিতরে শুয়ে শুয়ে ছটফট করতে থাকে আর কাফনের কাপড়ে মোড়ানো নিস্তব্ধ শরীরটা দেখে তোফাজ্জল খুব কষ্ট পেতে থাকে। কষ্ট পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক, নিজের লাশ কাফনে মোড়ানো দেখার পর নিশ্চয় অন্যকিছু পাওয়া সম্ভব নয়। খানিকবাদে আত্মাটি শরীর থেকে বের হয়ে খাটিয়ার উপরে উঠে বসে। অসহ্য লাগছে তার। হয়ত অস্থির অস্থিও লাগছে। মনে হচ্ছে খুব টেনশনে আছে। ঠিক এ মুহূর্তে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিকোটিন মস্তিষ্কের ভিতরে পৌঁছে দিতে পারলে নিউরনগুলো কিছুটা শিথিল হতে পারত। 

কিন্তু আফসোস, মৃতরা সিগারেট খেতে পারে না। তোফাজ্জল ক্রমশ দুর্ভাবনায় ডুবে যেতে থাকে। মৃত্যুর পরও তার দুঃচিন্তাগুলো তার পিছু ছাড়েনি। সে মনে মনে ভাবতে থাকে। সম্ভবত মৃত্যুর পর তার দুঃচিন্তাগুলো আরো বেশি বেড়ে গেছে। কারো কারো দুঃখ থাকে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিস্তৃত। দুঃখ যাদের ছায়ার মতো সঙ্গী। তোফাজ্জল হয়ত সেই হতভাগাদের দলের একজন কিংবা সেই হতভাগাদের ভিতরেও সে এক হতভাগা যে, মৃত্যুর পরও দুঃচিন্তার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। টেনশনে তোফাজ্জলের আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। 

দুঃচিন্তার পাশাপাশি তোফাজ্জলের আত্মার ভিতরে তীব্র একটি অপরাধবোধও কাজ করতে থাকে। সে বিষণ্ন হয়ে ভাবতে থাকে, এভাবে হুট করে মরে যাওয়াটা খুব জঘন্য একটা কাজ হয়েছে। আর কেউ না জানুক সে নিজে তো ভালোমতোই জানে এটা কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ছিল না। সে খুব সচেতন ও পরিকল্পিতভাবেই গাড়ির চাকার নিচে পড়ে মরেছে। অভিমান, ঘৃণা, দুঃখ আর রাগের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে এত বেড়ে গেছিল যে, সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। জগতে খুব কম লোকই হয়তো ওরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তোফাজ্জল অতটা মহৎ কিংবা মহামানব ছিল না কখনোই। সে খুব সাধারণ আর অভিমানী গোছের মানুষ ছিল। পৃথিবীতে বিশেষ এক ধরনের পাখি আছে যারা দুঃখ পেলে সহ্য করতে না পেরে মরে যায়, আত্মহত্যা করে। তোফাজ্জল কি সেই বিশেষ পাখি ছিল? থাকতে পারে, তবে সেটা আগের কোনো জন্মে- এ জন্মে সে নিরেট মানুষ ছিল। আর তার জীবন ছিল বকুল ফুলের মতো নির্মম। মৃত্যুর পরেও যাদের কোনো অবসর নেই।

খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে তোফাজ্জল তার পরিবার-সংসার নিয়ে নানানরকম দুঃচিন্তা করতে থাকে। দুঃচিন্তাগুলো মৌমাছির মতো ঝাঁক বেঁধে এসে ভীড় করছে তার মস্তিষ্কের ভিতর। তোফাজ্জলের আত্মা অস্থির হয়ে ভাবতে থাকে, মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, তাকে উপযুক্ত ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া ফরজ হয়ে গেছে। ছেলেটা মাত্র তিন বছরে পা দিয়েছে। এখনো অনেক ছোট। তাকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। বৃদ্ধ মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। এনজিও থেকে তোলা ঋণের সুদের টাকা, প্রতিমাসে বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যৎ বিল, এতসব কি করে সামলাবে কোহিনূর। আত্মহত্যা করাটা একদম ঠিক হয়নি তার। 

এভাবে সবাইকে বিপদের মুখে ঢেলে দিয়ে কাপুরুষের মতো জীবন থেকে পালিয়ে আসার ব্যাপারটা তোফাজ্জলকে খুব পীড়া দিতে থাকে। আত্মপীড়নের আগুনে সে দগ্ধ হতে থাকে। তোফাজ্জল মরে গিয়ে যেন আরো বেশি ফেঁসে গেছে। তপ্ত কড়াই থেকে বাঁচার আশায় লাফ দিয়ে জ্বলন্ত চুলার ভিতরে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে তার। ভেবেছিল মরে গেলে সবকিছু চুকে যাবে। অশান্তিময় জীবন থেকে মুক্তি পাবে, কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। 

বাড়িতে কোহিনূর কাঁদতে কাঁদতে ফিট হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। মায়ের সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটাও এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা পাগলের মতো করে হাউমাউ করে কাঁদছে। কয়েকজন লোক তাকে ধরে আছে। বাবার খাটিয়ার সঙ্গে যাওয়ার জন্য সে তাদের হাত থেকে ছুটতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

কিছুক্ষণ পর তোফাজ্জলের লাশের খাটিয়া কবরস্থানে পৌঁছায়। কবর খোঁড়া আছে। পাশেই বাঁশের টুকরো আর চাটাই। সবই পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রস্তুত আছে। লাশ কবরে শুইয়ে দিয়ে ‘মিনহা খালাকনাকুম ওয়া ফিহা নুইয়েদিকুম...’ পড়তে পড়তে সবাই একে একে মাটি চাপা দিতে থাকে তোফাজ্জলকে। সর্বশেষ ব্যক্তিটির হাতের মুষ্টির মাটি কবরে পড়ার পর চিরবিদায়ের দোয়া পড়ার ভিতর দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে তোফাজ্জলের যাবতীয় সম্পর্কের পাঠ চুকে যায়। তারপর সবাই একে একে যে যার বাড়ির দিকে চলে যায়। 

তোফাজ্জল অন্ধকার কবরে একা একা শুয়ে থাকে। তার ভয় করতে থাকে। জীবিতাবস্থায় সে কবরের জীবন সম্পর্কে যা যা শুনেছিল সব আস্তে আস্তে তার মনে পড়তে থাকে। সে আরো দুঃচিন্তাগ্রস্ত হতে থাকে। পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরও সে পৃথিবীর দুঃচিন্তাগুলো থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। 

কবরের বাইরে পূর্ণিমা-রাত, আকাশে ধবধবে উজ্জ্বল চাঁদ উঠেছে। আর তার অথৈ জোছনার প্লাবনে টাইটানিক জাহাজের মতো হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। দূরে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। কিন্তু এসবে আর তোফাজ্জলের কিছু যায় আসে না। সে এখন আর পৃথিবীর কেউ না। তোফাজ্জল অন্ধকার কবরে শুয়ে মুনকার নাকিরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সময় যেতে থাকে কিন্তু তারা আসছে না। কিছুটা বিরক্তিবোধ নিয়ে তোফাজ্জল ভাবতে থাকে তার জীবনে কোনো কিছুই ঠিক সময়ে আসেনি। অপেক্ষা করতে করতে সে নিজের অজান্তেই অপেক্ষার কৃতদাশ হয়ে গেছে। 

নিজের মৃত্যু নিয়ে তোফাজ্জলের আত্ম-অনুশোচনা থাকার পাশাপাশি কিছু ক্রোধও ছিল। কেননা তার মৃত্যুর কারণ তার স্ত্রী কোহিনূর। সে কোহিনূরকে খুব ভালোবাসত। দীর্ঘদিন প্রেম করার পরে তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর তোফাজ্জলের জীবনে ক্রমাগত ব্যর্থতার আক্রমণে সুখ নামক বস্তুটি ছিন্ন ভিন্ন হতে থাকে। এরকম দুঃসময় ওর জীবনে আরো অনেকবার এসেছিল এবং চলেও গিয়েছিল। এবারো হয়ত চলে যেত। 

তোফাজ্জল পরিশ্রমী এবং দৃঢ় মনোবলের মানুষ। দুঃসময়ের মতো সমস্ত কঠিন পরিস্থিতি সে মোকাবেলা করতে জানে। শুধু জানে না নিজের স্ত্রীকে নিজের বন্ধুর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলার পরের মুহূর্তটা কীভাবে সে মোকাবেলা করবে। তোফাজ্জল ওর বন্ধুর চরিত্রটা ভালোমতোই জানে। ওরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে, বেড়ে উঠেছে। বাড়ির আশপাশে কিছুদিন ঘুরঘুর করতে দেখে তার মনের ভিতরে একবার সন্দেহ তৈরি হয়েছিল কিন্তু আজ স্বচক্ষে দৃশ্যটি দেখার পর সে আর কোনো কিছু ভাবার সময় পায়নি। রাস্তা পার হওয়ার নাম করে সে কৌশলে গাড়ির চাকার নিচে লুটিয়ে পড়েছিল। হয়ত কোহিনূর কখনোই জানতে পারবে না ঠিক তার কারণেই তার স্বামী তোফাজ্জল আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু সবাই ভাবছে তোফাজ্জল রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। যদিও গাড়িটাকে কেউ ধরতে পারেনি। দূর থেকে কয়েকজন দেখে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসছিল। তারা আসতে আসতেই ড্রাইভার গাড়ি ইউটার্ন করে খুব দ্রুত হাওয়া হয়ে যায়। হয়ত ড্রাইভারও গোপনে মনে মনে নিজের একান্তে নিজেকে বিরবির করে খুনি বলছে। সেও অপরাধবোধে আক্রান্ত হচ্ছে। কিংবা দ্রুত স্পট থেকে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে বেঁচে যাওয়ায় সে মনে মনে গৌরব বোধ করছে।

কবরে রাত-দিন বলে কোনো কিছু নেই তোফাজ্জল তা জানে। যদিও এর আগে সে কখনোই কবরে শোয়নি, তবুও কবর সম্পর্কে সে বহুকিছু শুনে শুনে জেনেছে। কবরের অন্ধকার এতটাই ঘন এবং তীব্র যে, সে তার নিজের লাশটিকেও দেখতে পাচ্ছে না। তোফাজ্জলের ভীষণ ভয় করতে থাকে। অসহায় লাগতে থাকে তার। যদিও অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই, তবু সে দুহাত তুলে নিজেই নিজের জন্য দোয়া করতে থাকে। যেন সে অন্তত পৃথিবীর দুঃচিন্তাগুলো থেকে মুক্তি পায়। 

রাত বাড়তে থাকে আর তোফাজ্জল অন্ধকার কবরে শুয়ে মুনকার নাকিরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু মুনকার নাকির আসে না।  

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  গল্প   তোফাজ্জল   দুশ্চিন্তা  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

হামজা-শমিতদের ম্যাচ থেকে ৪ কোটির বেশি আয় বাফুফের
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে যোগ দিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩
দশমিনায় মৎস্য মেরিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

সর্বাধিক পঠিত

বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বান্দরবানে প্রার্থনা সভা
সাভারে টিভি সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরসি'র আত্মপ্রকাশ
ফটিকছড়িতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
বিএনপি নেতার পুকুরে বিষপ্রয়োগ
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close