প্রকৃতির নির্মম কষাঘাতে কেউ-কেউ প্রবল মেধাশক্তি থাকা সত্ত্বেও অকালে ঝরে পড়ে। না পাওয়ার বেদনায় সারাজীবন গুমরে গুমরে কাঁদে। তাদেরই একজন হাশেম। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল প্রবল মেধাবী। ক্লাসে শিক্ষকরা বলতেন- ‘এই ছেলেটা এক দিন অনেকদূর এগিয়ে যাবে।’ সহপাঠীরাও তার বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হতো। কিন্তু ভাগ্য কি আর সবার স্বপ্নকে পূর্ণতা দেয়। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন তার জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। হঠাৎ এক দিন তার দিনমজুর বাবা মারা যায়। রেখে যায় তার আরো দুই-কন্যাসন্তান ও স্ত্রী। সংসারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পড়ে-যায় হাশেমের ওপর।
মেধাবী ছাত্র থেকে হাশেম রাতারাতি পরিণত হলো- এক কিশোর শ্রমিকে। বই খাতা সরিয়ে রেখে সে পাড়ি জমালো দূরবর্তী গ্রামের এক ইটখোলায়। কিছুদিন মজুরের মতো কাজ করলেও, তার সততা, পরিশ্রম আর নিঃস্বার্থ মন দেখে ইটখোলার ম্যানেজার এক দিন তাকে ডাকলেন।
-‘হাশেম, তোকে আমি আমার সহকারী বানাব। তুই আমার চোখের সামনে সৎ ও পরিশ্রমী প্রমাণ করেছিস।’
সেদিন হয়তো হাশেমের বুকটা ভরে উঠেছিল এক অদ্ভুত গর্বে, কিন্তু মনের গভীরে একটা হাহাকার তখনো রয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে কলেজে হেসেখেলে পড়ার সুযোগ সে পায়নি।
সময়ের পরিক্রমায় তার বোনেরা বিয়ের উপযুক্ত হলো। অর্থের অভাবে তারাও লেখাপড়া করতে পারেনি। খুব কষ্টে হাশেম তাদের বিয়ে দিয়ে দিল। সংসারের দায়িত্ব একটু হালকা হলো। প্রতিটা কাজে মা তাকে সাহস যোগাত। মা-ই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু প্রকৃতি সেখানেও নির্মম হলো। এক দিন মাও চিরবিদায় নিলেন।
এবার সত্যিই হাশেম একা হয়ে গেল। বাপের রেখে যাওয়া ছোট্ট ভিটেবাড়ি ছাড়া তার আর কোনো সম্বল নেই। দিনশেষে ইটখোলা থেকে ফিরলে ফাঁকা উঠোন আর নীরব ঘর তাকে ঘিরে ধরে। মাঝে মাঝে সে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে- ‘আমি যদি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারতাম, যদি বাবাকে একটু বেশিদিন পাশে পেতাম--তাহলে হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো।’
কিন্তু হতাশার ভিড়ে থেকেও হাশেম হাল ছাড়ে না। গ্রামে মানুষ জানে সে সৎ। কেউ সমস্যায় পড়লে ছুটে যায় তার কাছে। হয়তো নিজের জীবনের আলো জ্বালাতে পারেনি, কিন্তু অন্যের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে যায় নীরবে।
তার জীবন যেন এক নীরব শিক্ষার গল্প- যেখানে স্বপ্ন ভেঙে গেলেও দায়িত্ব আর সততা মানুষকে টিকিয়ে রাখে।
এক বিকালে ইটখোলার কাজ শেষে হাশেম ম্যানেজারের অফিস থেকে বের হচ্ছিল। ইঠাৎ ম্যানেজার বললেন, ‘হাশেম, কলিমুদ্দি কয়েকদিন ধরে কাজে আসছে না। শুনেছি অসুস্থ।’ একটু খবর নিস তো।
এ কথা শুনে হাশেমের মন খারাপ হয়ে যায়। কলিমুদ্দি চাচা তার পাশের গ্রামের লোক। তিনি খুব নিরীহ। কর্মক্ষম ছেলে থাকতেও এ বয়সে তাকে ইটখোলায় কাজ করতে হয়।
পরদিন সকালেই হাশেম বাইসাইকেলে চড়ে রওনা দিল কলিমুদ্দি চাচার বাড়ির দিকে। গ্রামের সরুপথে সাইকেলের চাকার ঘর্ষণে ধুলা উড়ছিল। আর ভেতরে ভেতরে তার মনে এক অদ্ভুত টান কাজ করছিল।
বাড়িতে পৌঁছে দেখে মাটির ঘরের বারান্দায় একটি খাটে শুয়ে আছেন কলিমুদ্দি চাচা। শরীর কিছুটা শুকিয়ে গেছে, তবে মুখে হাসি।
-কশেম! তুই এসেছিস, বাবা?
হাশেম সাইকেলাটা দাঁড় করে এগিয়ে এসে সালাম দিল।
-‘চাচা, শুনলাম আপনি কয়েকদিন ধরে ভুগছেন। তাই দেখতে এলাম।’
-‘হ্যাঁ বাবা, জ্বরে কাহিল হয়ে গেছি।’
কলিমুদ্দিন চাচার স্ত্রী ভেতর থেকে বের হলেন। কুশল জিজ্ঞেস করলেন হাশেমকে। কিছুক্ষণ পর তার মেয়েও ঘর থেকে বের হলো। চাচা হাশেমকে তার মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমার মেয়ে মনিষা। লেখাপড়ায় খুব ভালো। এ বছর দাখিল পরীক্ষায় এ+ পেয়েছে। আলিমে ভর্তি হয়েছে।
তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। গার্মেন্টসের এক মেয়েকে বিবাহ করেছে। বাড়িতেও আসে না, কোনো টাকা পয়সাও পাঠায় না। মেয়েটিই আমার সবকিছু। হাশেম মেয়েটিকে লক্ষ্য করল।
কালো বোরকার আড়ালে পুরো শরীর ঢাকা, মুখে নেকাব। কেবল চোখ দুটোই দেখা যায়। সে এগিয়ে এসে হাশেমকে সালাম দেয়।
-‘আসসালামু আলাইকুম’।
সেই কণ্ঠস্বর-- অদ্ভুত কোমল, অদ্ভুত মিষ্টি। হাশেম যেন মুহূর্তেই থমকে গেল। বুকের ভেতর-এক অচেনা অনুভূতি খেলে গেল, যা সে আগে কখনো টের পায়নি।
হাশেম লাজুকভাবে উত্তর দিল- ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
কথাবার্তা শেষে হাশেম কলিমুদ্দি চাচার কাছে বিদায় নিল। বিদায়ের প্রাক্কালে চাচা বলল, ‘আর একটু সুস্থ হলেই সে কাজে যাবে।’
হাশেম বাইসাইকেলটা নিয়ে ইটখোলার দিকে রওনা দিল। সমস্ত রাস্তায় মেয়েটির কোমল কণ্ঠস্বর তার কানে বাজতে লাগল। তার নেকাব ঢাকা মুখ না দেখা গেলেও সেই কণ্ঠস্বর হাশেমের হৃদয়ে যেন এক অদ্ভুত আলো জ্বালিয়ে দিল।
কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে আবার ইটখোলার কাজে যোগ দিল কলিমুদ্দি চাচা। আগের মতোই কষ্ট করে মাটি কেটে, ইট বহন করে, ঘামে ভিজে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
কিন্তু এক দিন দুপুর বেলা হঠাৎ ইটখোলায় হৈচৈ শুরু হলো। খবর এলো কলিমুদ্দি চাচা মাটির স্তূপের পাশে প্রচণ্ড পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
হাশেম দৌড়ে গেল। চাচার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে। এক মুহূর্ত-বিলম্ব করল না সে। চাচাকে কোলে তুলে ইটখোলার ভ্যানগাড়িতে উঠাল। নিজেই ভ্যানের পেছনে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে সদর হাসপাতালের দিকে ছুটল।
হাসপাতালের ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মুখ গম্ভীর করে বললেন-
‘রোগীর এপেনডিক্সে’ গুরুতর ইনফেকশন হয়েছে। অপারেশ ছাড়া উপায় নেই, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে জীবন হানি ঘটতে পারে। রোগীর ওয়ারিশ কে?
হাশেম ইতঃস্তত করে উত্তর দিল, আমি।
- কাউন্টারে যান। দ্রত কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন।
রোগীকে এখনই ‘ওটি’তে নিতে হবে।
কলিমুদ্দি চাচা করুণভাবে তাকালেন হাশেমের দিকে। হাশেম দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘চাচা, আপনার অপারেশন হবে। টাকা পয়সার চিন্তা করবেন না। আমি আছি। তারপর দ্রত কাউন্টারের দিকে চলে গেল।
সদর হাসপাতালের সাদা করিডরে টানটান উত্তেজনা। কলিমুদ্দি চাচাকে অপারেশ-থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। বাইরে বসে অপেক্ষা করছে হাশেম। বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে, তবুও চেহারায় শক্তভাব ধরে রেখেছে।
ইতোমধ্যে খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছে কলিমুদ্দি চাচার স্ত্রী ও মেয়ে। মেয়েটি তখনো বোরকা- নেকাবে ঢাকা, কেবল চোখ দুটো খোলা। মা-মেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বারান্দায় দাঁড়াতেই হাশেম উঠে দাঁড়ালো।
চাচির চোখ লাল হয়ে গেছে কান্নায়। তিনি হাশেমের হাত ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।
হাশেম সান্ত্বনা দিয়ে বলল, চাচি, কাঁদবেন না। চাচার কিচ্ছু হয়নি। তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন।
মেয়েটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। সে হাশেমকে সালাম দিল।
আসসালামু আলাইকুম।’
কণ্ঠস্বরটা আবারো হাশেমের হৃদয়ে এক অচেনা আলোড়ন তুলল। তার চোখের পেছনে লুকানো মায়া যেন বুকের ভেতর ঢেউ তুলল।
অপারেশন থিয়েটারের দরজার তখনো লাল বাতি জ্বলছে। বাইরে বসে ওরা নীরব প্রহর গুনছে আর আল্লাহকে মনে মনে স্মরণ করছে।
অবশেষে ডাক্তার বেড়িয়ে এসে জানালেন- ‘অপারেশন সফল হয়েছে। এখন রোগীকে কেবিনে আনা হবে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসবে।’
সবার বুক থেকে যেন দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। অল্প সময়ের মধ্যেই চাচাকে কেবিনে এনে বেডে শোয়ানো হলো। স্যালাইন পুশ করা হয়েছে। মুখে মাস্ক পরানো। চাচার চোখ এখনো বন্ধ, শরীর নিস্তেজ।
চাচি বেডের পাশে বসে স্বামীর হাত ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেয়েটি তার মায়ের পাশে বসে চুপচাপ বসে আছে। হাশেম পাশে বসে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছে-
-‘চাচি, ভয় পাবেন না। ডাক্তার বলেছেন, এখন আর কোনো ঝুঁকি নেই। অল্প সময়েই চাচা সুস্থ হয়ে উঠবেন। ইনশাআল্লাহ।’
কথা বলার সময় হাশেমের গলায় ছিল দৃঢ়তা, চোখে ভেসে উঠছিল মমতা। তার বুকের ভেতর ভারী একটা অনুভূতি ঘুরছিল। সে জানে, নিজের স্বপ্নগুলো হয়তো অনেক আগেই ঝরে গেছে। কিন্তু অন্যের জন্য বাঁচতে পারাটাই এখন তার একমাত্র শক্তি।
কিছুক্ষণ পর নার্স এসে বলল, ‘একটি ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে।’
হাশেম ব্যবস্থাপত্র হাতে নিল এবং বাইরে বের হওয়ার জন্য দাঁড়ালো। ঠিক তখনই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল।
চাচার মেয়ে মনিষা যে সব সময় পর্দানশীল। বোরকা-ও নেকাবে মুখ ঢেকে রাখত। হঠাৎ অবচেতন মনে মুখ থেকে নেকাবটা নামিয়ে দিল। হয়তো গরমে অস্বস্তি হচ্ছিল, কিংবা ক্লান্তির কারণে নিজের অজান্তেই সে নেকাব খুলে ফেলল। মৃদুস্বরে বলল, ‘হাশেম ভাই, ওষুধ কেনার টাকা নিয়ে যান।’
হাশেম থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল মনিষার মুখে। যে মুখ সে আগে কখনো দেখেনি আজ যেন হঠাৎ করে এক পর্দা সরে গিয়ে প্রকাশ পেল।
মনিষার মুখশ্রী এমন ছিল যেন নিখুঁত কারুকার্যে গড়া। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙে, লাবণ্য ছড়িয়ে আছে। কপালের হালকা চুলের গোছা, ক্লান্তি সত্ত্বেও সৌন্দর্যকে আরো গভীর করে তুলেছিল। সরু নাক, মসৃণ ঠোঁট, আর শান্ত মায়াভরা চোখের চারপাশে এক অদ্ভুত আকর্ষণ যেন আলো ছড়াচ্ছিল।
হাশেম বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। মনে হলো এতোদিন বুকের ভেতর লুকানো যে অচেনা অনুভূতি তাকে অস্থির করে তুলতো তারই উত্তর আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
তার কানে তখনো বাজছিল মনিষার কোমল কণ্ঠস্বর। ‘হাশেম ভাই, টাকা নিয়ে যান।’
হাশেম সম্বিত ফিরে পেল। লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠল।
মৃদু হেসে বলল, ‘লাগবে না। আমার কাছে টাকা আছে।’
হাশেম বের হয়ে গেলেও তার মন হাসপাতালের করিডরে আটকে থাকল মনিষার সেই অবাক করা সৌন্দর্যের কাছে।
হাসপাতালে কেবিনে দিন কেটে যাচ্ছিল ধীর গতিতে। কলিমুদ্দি চাচা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। চাচির বেশিরভাগ সময় স্বামীর সেবা শুশ্রুষায় কাটত। তাই-ফাঁকে ফাঁকে মনিষা ও হাশেমের মাঝে ছোট ছোট কথোপকথন হতো।
সেই কথাগুলোতে কখনো লাজুক হাসি, কখনো অদৃশ্য টান লুকিয়ে থাকত।
এক বিকালে চাচা ঘুমিয়ে পড়েছেন। চাচি ঠান্ডা পানি আনতে একটু বাইরে গেছেন। মনিষা বিছানার পাশে বসা আর হাশেম চেয়ারে। জানালা দিনে নরম বাতাস ভেতরে আসছে।
মনিষা নরম স্বরে বলল, হাশম ভাই, এতো কষ্ট করছেন আমাদের জন্য।এর প্রতিদান যে কীভাবে দিব।’
হাশেম মৃদু হেসে জবাব দিল-’ প্রতিদান চাই না। শুধু চাই তোমরা ভালো থাক।’
মনিষা মাথা নিচু করে রইল। মুখের ভেতর লাজুক হাসি খেলে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার বলল-’ আপনি না থাকলে- আমরা হয়তো আজ একেবারেই ভেঙে পড়তাম।’
হাশেম তাকিয়ে রইল মনিষার চোখের দিকে। সে চোখে ছিল ‘কৃতজ্ঞতার আড়ালে এক কোমল টান। হাশেম একটু হেসে বলল,’ আমাকে আল্লাহ হয়তো এজন্য পাঠিয়েছেন।
দুজনেই কিছুক্ষণ নিরব রইল। সেই নীরবতাতেই যেন হাজার অপ্রকাশিত কথা ভেসে উঠলো।
অন্য আরেকদিন হাসপাতালের বাগানের বেঞ্চে বসে ছিল হাশেম ও মনিষা। মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। দূরে আলো-আঁধারি। করিডরে নার্সদের চলাফেরা।
হাশেম একটু দ্বিধা নিয়ে বলল -’একটা কথা জিজ্ঞেস করি, মনিষা?
মনিষা চোখ নিচু করে মৃদু হেসে বলল-‘জিজ্ঞেস করুন।’
হাশেম তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
‘তুমি তো সব সময় নেকাবে মুখ ঢেকে রাখো। কেন এমন করো?’
মনিষা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল-
‘কারল আমি সব সময় চেযেছি, আামার মুখ কেবল সেই মানুষটি-ই দেখুক যে হবে আমার জীবন সঙ্গী। আমার হায়া, আমার পর্দা- সেটাই আমার অলংকার।’
হাশেমের বুক ধক করে উঠল। একটু থেমে সে আবার প্রশ্ন-করল-
-‘তাহলে আমাকে তোমার মুখ দেখালে কেন?’
প্রশ্নটা যেন বাতাশে ঝুলে রইল। মনিষা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে নিচের দিকে তাকাল। তারপর ধীরধীরে মৃদু হেসে বলল- ‘এই প্রশ্ন আমি নিজেকে করি, কেন এমন করলাম।
হাশেম চুপ করে রইল। বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
মনিষা আবার হাশেমের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল - ‘বলুন তো, এর উত্তর- আপনার কাছে আছে কী?’
হাশেম কোনো উত্তর দিল না। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল মনিষার মুখের দিকে যেন হাজারো উত্তর লুকিয়ে আছে সেই সৌন্দযে, যা শুধু তার জন্য উন্মোচিত হলো।
সন্ধ্যার পর হাসপাতালের করিডোর যেন নতুন এক জীবনের কোলাহলে ভরে উঠে। দেয়ালের সাদা রঙের টিউব লাইটের স্লান আলো পড়ছে তাতে যেন সময় থেমে গেছে। হাশেম এক কোনে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। কেউ হইল চেয়ারে করে ভেতরে ঢুকছে- চোখে ভয়, কপালে ঘাম। আবার কেউবা সুস্থ হয়ে বেরোচ্ছে। মুখে স্নিগ্ধ হাসি, সংগে স্বজনদের খুশির উল্লাস। সব মিলিয়ে যেন সিম্ফনি বাজছে এই করিডরে। হাশেম আনমনা হয়ে গেল।’ কী অদ্ভুত এই পৃথিবী। একই করিডোরে এক দিকে কান্না অন্যদিকে হাসি। একদিকে বিদায়ের প্রস্তুতি অন্যদিকে নতুন শুরু।
প্রতিদিনের মতো আজো হাশেম হোটেল থেকে চাচা-চাচি ও মনিষার জন্য রাতের খাবার আনার জন্য প্রস্তুত হলো।
হাশেম মনিষার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘তুমি কি যাবে আমার সাথে?’
মনিষা একটু ইতঃস্তত করল। তারপর নরম গলায় বললল, ‘যাই। তবে দ্রুত ফিরতে হবে।’
তারা দুজন হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে এলো। কৃষ্ণপক্ষের রাত। কিন্তু শহরে বুঝা যায় না বিজলী বাতির কারনে।
হাশেম মনিষা পাশাপাশি হাঁটছে। হাশেম আকাশের দিকে তাকাল। অসংখ্য তারা ঝলমল করছে। হাশেম মনিষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখো মনিষা, এই তারকারাজি- -, -কত ঝলমলে কত সুন্দর যেন একেকটা প্রদীপ হয়ে জ্বলছে।’
মনিষা মৃদু হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘হ্যাঁ, আল্লাহর দৃষ্টি সত্যিই অপরূপ।’
হাশেম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর গভীর কন্ঠে বলল, ‘জানো, এই অসংখ্যা তারার মাঝে আছে একটি ধ্রুব তারা। দিক ভ্রান্ত পথিককে পথ দেখায় একমাত্র এই ধ্রব তারা।’
হাশেম হাঁটতে হাঁটতে স্মিতহাস্যে বলল- মনিষা, তুমি যে পরিবারে বউ হয়ে যাবে সেই পরিবার আলোকিত হয়ে উঠবে। তুমি তোমার জীবন সঙ্গীর ধ্রুব তারা হয়ে থাকবে।’
কথাগুলো বলে হাশেম থেমে গেল। বুকের ভেতর তার লুকানো ভালোবাসা তোলপাড় করছে, কিন্তু সে মুখে সরাসরি বলতে পারছে না।
মনিষা একটু থেমে নরম কণ্ঠে বলল, ‘ কেউ কি সত্যিই এমন ভাবে! আমার মুখ তো পর্দার আড়ালে, আমার জীবন তো সবার চোখে সাধারণ। আমি তো শুধু দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে বাঁচতে চাই।’
দুজনেই আর কোনো কথা বলল না। শুধু নিস্তব্ধ রাতে তাদের হাঁটার শব্দ আর হৃদয়ের নীরব ধ্বনি মিলে এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি বুনে দিল।
রাত গভীর। হাসপাতালের করিডর নিস্তব্দ হয়ে এসেছে। শুধু নার্সদের পায়ের শব্দ আর মাঝে মাঝে গুরুতর রোগীদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।
কেবিনের ভেতরে কলিমুদ্দি চাচা, চাচি ও মনিষা শুয়ে আছে। কিন্তু মনিষার চোখে ঘুম নাই। তার মনে বারবার ভেসে উঠছে বারান্দায় শুয়ে থাকা হাশেমের মুখ। কী অদ্ভুত মানুষ। সবার কষ্ট নিজের কাধে নিয়ে নেয়। অথচ নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখে। এ রকম মানুষের উপর জীবনে ভরসা করা যায়।
মনিষা আস্তে আস্তে-দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে দেখে হাশেম বিছানায় আধা শোয়া হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ক্লান্তি অথচ দৃষ্টি গভীর। আয়েশা ধীরে ধীরে গিয়ে তার পাশে বসলো।
‘এখনো ঘুমাননি?’
হাসেম মাথা নিচু করে বলল- ‘না, নানা চিন্তা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।’
মনিষা তাকিয়ে রইল তার দিকে। চোখে গভীর সহানুভূতি।
‘আপনি সবসময় অন্যদের জন্য কষ্ট করেন, নিজের কথা কখনো ভাবেন না।
হাশেম কোনো কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তারপর মনিষার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করল-
‘ মনিষা, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? ভবিষ্যতে কী হতে চাও?
মনিষা একটু চুপ করে রইল।তার চোখে লাজুক ঝিলিক।
‘ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। মানুষের সেবা করতে চাই। হাসপাতালে এসে সেই স্বপ্ন দৃঢ় হয়েছে।
হাশেম মৃদু হেসে বলল, ‘চমৎকার স্বপ্ন। সত্যিই তুমি পারবে।’
মনিষা একটু থেমে নিচু স্বরে বলল, ‘তবে আরেকটা স্বপ্নও আছে।’
হাশেম কৌতূহল ভরে তাকালো-
-আর কী স্বপ্ন?
মনিষা চোখ নামিয়ে নিল। নেকাবের আড়ালে ঠোঁট ‘কাঁপছে। ফিস ফিস করে বলল-
-‘আপনার মতো একজন বটবৃক্ষ তালাশ করা- যার ছায়ায় সারাজীবন শান্তিতে থাকতে পারব।
কথাটা শুনে হাশেমের বুক কেঁপে উঠল। সে মনিষার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকাল।
ম্লান আলোয় তার চোখ দুটো রহস্যে ভরা। অথচ নিঃশব্দে অনেক কিছু বলছে।
মনিষা হাশেমের পাশে চুপচাপ বসে রইল।
তার মনে হচ্ছিল হাশেম কিছু বলতে চাইছে- বলতে পারছে না। মনিষা বুকের ভেতর হালকা ব্যথা টের পেল। সে মনে মনে ভাবলো-
‘আমি বুঝি, সে আমাকে ভালোবাসে। তার চোখ বলছে, তার নীরবতা বলছে। তবুও সে কেন লুকায়? ‘মনিষা নিঃশব্দে একটা দৃষ্টি-ছুড়ে দিল হাশেমের দিকে। তার চোখ যেন বলতে চাইছে-
‘তুমি যদি কিছু না বলো, তবুও আমি জানি। ভালোবাসা কথায় নয় নীরবে হৃদয়ে বাঁচে।’
কিন্তু লাজুক প্রকৃতির মনিষা সরাসরি কিছু বলতে পারলো না। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। কেবিনের দিকে ফিরে যাচ্ছিল।কিন্তু শেষ মুহূর্তে আবার থেমে হাশেমের দিকে তাকাল।
মৃদু স্বরে বলল-
‘আকাশে অনেক তারা, কিন্তু পথ দেখায় শুধু ধ্রুব তারা। এ কথাটি বলে চলে যেতে যেতে হাশেমের দিকে আর একবার তাকাল।
হাশেম স্তব্ধ হয়ে রইল। বুকের ভেতর ঝড় বইতে লাগল। সে বুঝল- আয়েশা সরাসরি-না বললেও তার মনের দরজা খুলে দিয়েছে।
কলিমুদ্দি চাচা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। আগামীকাল সকালে তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হবে। হাশেম হাসপাতালের কেবিনের ও ওষুধের দোকানের বিল পরিশোধ করে দিল। চাচি হাশেমের হাত ধরে অসহায়ত্বের স্বরে বলল, ‘তোমার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল। এ টাকা যে আমরা কী পরিশোধ করবো? হাশেম আশ্বাস দিয়ে বললো, ‘চাচি,এ টাকা শোধ করা লাগবে না। শুধু আমার জন্য একটু দোয়া করবেন।’ চাচি হাশেমের মাথায় হাত দিলো।। দোয়া করি বাবা, ‘তুমি অনেক বড় হবে।’
এ কথা বলে চাচি শাড়ির আঁচল দিয়ে তার দুচোখ মুছতে লাগল।’
মনিষা রাতেই ছোট একটা ছোট্ট ব্যাগে কাপড়-চোপড় গোছগাছ করলো। সকালেই তাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
হাসপাতালের করিডর। নিস্তব্ধ রাত। দূর আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। হাশেম রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। মনের ভেতর শুধু একটিই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে - ‘মনিষার কাছাকাছি যাওয়া কী ঠিক হবে? নিজের জীবন বরবাদ হয়েছে। তার কারণে অন্যের জীবন বরবাদ হোক সেটা সে চায় না।’
মনিষা ধীরেধীরে হাশেমের কাছে এসে শান্তস্বরে বলল, আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছেন?
হাশেম মনিষার দিকে তাকিয়ে মাথা নিছু করে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানো মনিষা, পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক আছে যা আকাশের তারার মতো- দূর থেকে অনুভব করা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না।’
মনিষার বুক কেঁপে উঠলো। সে ধীরে ধীরে হাত রাখলো হাশেমর হতের কাছে।নিচু স্বরে বলল, ‘তারা ছোয়া যায় না ঠিকই কিন্তু আকাশ তো তারাদের নিয়েই বেঁচে থাকে। ছোঁয়া না গেলেও তারা আকাশের অঙ্গ হয়ে থাকে সারাজীবন।
হাশেম মাথা নিচু করে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু শব্দ খুঁজে পেল না। শুধু অদৃশ্য কষ্টে তার বুক ভেঙে গেল। মনিষার চোখে অশ্রুর ঝিলিক দেখা দিল। সে আর কিছু বলল না শুধু রেলিং এ রাখা হাতটা সামান্য কাঁপলো- যেন স্পর্শের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করল।
গ্রামের ফেরার পরের এক নিস্তব্ধ রাত। হাশেমের জীবনে চলছিল এক ভয়ংকর মানষিক টানাপোড়েন।
হাশেম একা বসে আছে ভিটেবাড়ির উঠোনে। মাথার ওপর তারা ভরা আকাশ। চোখ দুটো ক্লান্ত, ভেতরে জমে আছে আগুন। নিজের সঙ্গে কথা বলে শুরু করলো- তার মনে ছিল প্রবল আকাক্সক্ষা মনিষাকে পাওয়ার। তার কণ্ঠস্বর, তার সৌন্দর্য, তার সহানুভূতি হাশেমকে গভীর আবেগে ভাসাত। এই আকাক্সক্ষাই তার অবচেতন মনের চাহিদা যা যুক্তি মানে না, শুধু তৃষ্ণার মতো টেনে নেয়। কিন্তু সে আকাক্সক্ষার দাস হয়ে থাকতে চায় না।সে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেছে।সে বুঝেছে তার দারিদ্র্য, তার নিরাশ্রয় জীবন ও ভবিষ্যৎহীনতা মনিষার বড় স্বপ্নকে বাধাগ্রস্ত করবে। ভালোবাসা থাকলেও জীবনে সমানে সমান না হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হাশেমের বিবেক সিদ্ধান্ত নেয় মনিষাকে ভালোবাসা মানে তাকে নিজের করে নেয়া নয় বরং তার স্বপ্ন পূরণের পথে মুক্তি দেওয়া, নিজের আকাক্সক্ষাকে বিসর্জন দেওয়া।
হাশেম এখন আর কলিমুদ্দি চাচার বাড়িতে আগের মতো যায় না। মনিষার সাথে তার দেখাও হয় না। মনিষা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কাজের চাপে এমন হচ্ছে। কিন্তু দিন কেটে সপ্তাহ হয়ে গেল, অতঃপর মাস পেরিয়ে গেল। হাশেম একবারও কলিমুদ্দি চাচার বাড়ি গেল না।
মনিষা খুব কষ্ট পেল। তার বুক হাহাকার করে উঠল। সে সাহস সঞ্চয় করে প্রতিবেশি এক ছোট ছেলের হাতে বার্তা পাঠাল । ‘হাশেম ভাই, কাল সন্ধ্যায় একবার আমাদের বাড়িতে আসবেন। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই।’
বার্তাটি পেয়ে হাশেমের বুক কেঁপে উঠল। সে অনেকক্ষণ কাগজের টুকরোর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হলো প্রতিটি অক্ষর যেন তার হৃদয়ের ভেতর খোঁচা মারছে।
সন্ধ্যা নামতেই চারপাশে অন্ধকার নেমে এলো। দূরের আকাশে জ্বল জ্বল করছে তারা, হাওয়ায় পাতার মৃদু শব্দ।
মনিষাদের উঠানোর বড় আম গাছের নিচে এসে দাঁড়াল হাশেম। বুকের ভেতর ঢাকের মতো বাঁজছে হৃৎস্পন্দন। কিছুক্ষণ পর নীরবতার ভেতর মনিষার পায়ের শব্দ শোনা গেল। ধীরে ধীরে এগিযে এলো সে। আজ তার নেকাব নামানো। তার চোখ দুটো ভেজা।কিন্তু সেই চোখে জমে আছে অজস্র প্রশ্ন।
হাশেম তাকাতেও পারছে না সেদিকে। কেবল বুকের ভেতর এক অজানা ঝর বইতে লাগল।
মনিষা মৃদুকণ্ঠে বলল-
কেন এভাবে দূরে সরে যাচ্ছেন। আমি কি কোন ভুল করেছি?
এই প্রশ্নের ভেতরেই জমেছিল অসংখ্য আবেগ, ভালোবাসা, অভিমান আর অশ্রু।
হাশেম মন শক্ত করে মনিষারর দিকে তাকাল। বিষণ্ন কণ্ঠে বলতে লাগল-
‘হাসপাতালের দিনগুলোতে আমাদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তাতে আমাদের মনে ভালোবাসার একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে- এটা নিশ্চিত। আমি ভেবে দেখেছি এটা লালন করা অসম্ভব। কারণ বাস্তব বড় নির্মম। তোমার জীবনে একটা অপার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমার কিছুই নাই। কেউ যদি চাঁদের মতো কিছু চায় তাকে সূর্যের মতো হতে হয়। সে ক্ষমতা তো আমার নাই। শুধু মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?’
হাশেমের কথার পর যেন বাতাস ভারী হয়ে গেল। হাশেম মুখ ঘুরিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। আর মনিষার চোখ ভিজে গেল কান্নায়। হঠাৎ মনিষা ভাঙা কণ্ঠে বলতে লাগলো ‘হাশেম ভাই, কী বলছেন এগুলো? ভালোবাসা তো হৃদয়ের টান, সেখানে এতোসব চিন্তা আসে কীভাবে?
হাশেম এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। তারপর গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘মনিষা, বোঝার চেষ্টা কর। ভবিষ্যতের কথা বর্তমানে চিন্তা করতেই হয়। আজ আবেগে ভেসে গেলে কাল কষ্টের শ্রোতে ডুবে যাব আমরা দুজনেই। আমি চাই না তোমার জন্য সেই অন্ধকার তৈরি হোক। তোমার লক্ষ্য অনেক দূরে, আর আমি- আমি তোমার পায়ে শিকল হয়ে থাকতে চাই না।
মনিষার বুক ফেঁপে উঠল। যে অসহায়ের মতো ফিস ফিস করে বলন ।
‘তাহলে? এ-ই কি শেষ কথা? এত দিনের মায়া এত স্বপ্ন... সব ভেঙে যাবে এভাবে?
হাশেম কষ্টে মুখ ফিরিয়ে নিল। চোখের কোণে জমা জল মুছে ফেলল হাতের আড়ালে।
‘হ্যাঁ মনিষা- হয়তো এটাই আমাদের জন্য ভালো। তোমাকে হারানো আমার জন্য দুঃখ, কিন্তু তোমাকে আটকে রাখা আমার অন্যায়।’
দুজনেই আর কিছু বলল না। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ যেন আরো তীব্র হয়ে উঠল। নিস্তব্ধতার ভেতর শুধু তাদের নিশ্বাস আর কান্নার শব্দ ভেসে বেড়াতে লাগল।
মনিষা ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। আর হাশেম দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর রাতের অন্ধকারে গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেল।
কেউ বলল সে নাকি শহরে চলে গেছে কাজ খুঁজতে। কেউ বলল সীমান্ত পার হয়ে চলে গেছে দূরদেশে। কিন্তু আসল সত্য কেউ জানল না।