আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনীতির মাঠে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল খুঁজছে দলটি। কর্মী-সমর্থকরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন।
প্রতিদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করছেন তারা। দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের পুনর্বাসনের চেষ্টাও চলছে। পাশাপাশি নির্বাচন ঠেকাতে দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগ ও অদৃশ্য শক্তির যোগসাজশে গোপন বৈঠকও করা হচ্ছে। যা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অদৃশ্য শক্তির হস্তক্ষেপে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে। অদৃশ্য বলয়ে থেকে দলটি নিজেদের রক্ষা করছে। আর যে বৈঠক হয়েছে তা বোঝার জন্য আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থানকে বিবেচনায় রাখা জরুরি।
এদিকে আওয়ামী লীগ দেশের অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে। এ ছাড়া সাবেক সরকারের অনুগত পুলিশ, প্রশাসন, গোয়েন্দা ও সামরিক চক্রগুলো আজও সক্রিয়। এদের অনেকেই চুপচাপ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ও ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করার জন্য সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিদেশি বিভিন্ন চক্রও সক্রিয় রয়েছে। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে আবারো অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের অনুগত শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো। বাইরের শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে দেশের ভেতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে দলটি।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। দেশেও আত্মগোপনে রয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। ইতোমধ্যে দলটির সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নিবন্ধনও স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। তা ছাড়া জুলাই আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলমান দলটির।
তবে বর্তমানে আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। মামলা-হামলায় তারা বিচ্ছিন্ন না হয়ে আরো সুসংগঠিত হচ্ছেন। প্রতিদিনই ঝটিকা মিছিল করছেন। তা ছাড়া কৌশলের অংশ হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে বেশকিছু গোপন বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধের সুযোগ নিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছেন নেতাকর্মীরা। দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন তারা। বর্তমানে রাজধানীতে এমন অসংখ্য অটোরিকশাচালক আছেন, যারা আওয়ামী লীগের আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মী। তারা ছদ্মবেশে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। যে কোনো সময়-সুযোগে তারা বিশাল আকারে আন্দোলনে নামতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একইসঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে-তৃণমূলে বিশেষ দলের আশ্রয়ে থেকে নিজেদের ঘুচানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ একযুগে আন্দোলনকে সুসংগঠিত ও সফল করতে দলের বহিষ্কৃত নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে। গতকাল মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পেজ-এ প্রকাশ করা হয়েছে। চিঠিতে গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও মহানগর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমসহ সব বহিস্কৃত নেতাদের ক্ষমা প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছে। শক্তি সঞ্চয় করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করছে। মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ, খুব দ্রুতই ফিরবেন শেখ হাসিনা এমন তথ্য প্রচার করছে। সূত্র বলছে, ৭ ডিসেম্বরই হবে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। এর আগে নভেম্বরেও নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। সেখানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগের কৌশলের অংশ হিসেবে মনে করছে অনেকে।
গত রোববার এইচআরডব্লিউ’র ওয়েবসাইটে ওই চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রোধে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে। গুম-খুনের বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ), বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজের অধিকার রক্ষায় কাজ করা দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক সংস্থা সিভিকাস, রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা থাইল্যান্ডভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফোরটিফাই রাইটস, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট এ চিঠিটি দিয়েছে। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে মানবাধিকার সংক্রান্ত নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে যৌথ এ চিঠিটি দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে যাদের ভুলের খেসারত দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলকে আজকের এ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে, সেই দুর্নীতিবাজ-লুটেরা এখনো বিদেশে বসে কলকাঠি নাড়ছেন। ক্ষমতা হারানোর পর একবছর হয়ে গেলেও তাদের কারো মধ্যে ভুল স্বীকারের তাগিদ নেই, নেই ন্যূনতম অনুতাপ। বরং নিয়মিত নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইছেন। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছেন তারা।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতিদিন গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ১১ স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসব ঝটিকা মিছিলে অভিযান চালিয়ে ১৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে।
পুলিশ বলছে, বেশ কয়েকটি স্থানে মিছিলের সময় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। কাউকে মিছিল থেকে, আবার কাউকে মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনো কোনো মিছিলে ৫ থেকে ৩০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে দেখা গেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেট ও মতিঝিলের রাজউক ভবনের গলিতে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। পল্টন থানা-পুলিশ বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে মো. ওয়াসিম (৪০) ও মো. ফয়সাল (৩০) নামের দুজনকে গ্রেফতার করে। রাজউক ভবনের গলিতে মিছিলের প্রস্তুতিকালে মো. কায়েস হাসান (২৪) নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার তেজগাঁও এলাকার সাতরাস্তা মোড়ে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের ১২ থেকে ১৫ জন নেতাকর্মী ৩০-৪০ সেকেন্ডের একটি ঝটিকা মিছিল করেছেন। এ সময় তারা ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। বেলা ১১টার একটু পর খিলক্ষেত থানার গলফ ক্লাবের সামনে ৩০ থেকে ৪০ জন ঝটিকা মিছিল করেন। মিছিল থেকে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের এখন যা করার, তা না করে গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় চলছে। সত্যিটা মেনে নিয়ে দলকে নতুন উদ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। তা না করে ভাব দেখানো হচ্ছে শেখ হাসিনা এখনো প্রধানমন্ত্রী! প্রশাসনের সবাই তার জন্য কাজ করবে ও তিনি একদিন আনুষ্ঠানিকভাবে গদিতে বসবেন! শেখ হাসিনা যদি দূরদর্শী হতেন, তাহলে তার সরকারের ব্যর্থতার নেপথ্যে যারা ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে নতুন নির্দেশনা দিতেন। যুদ্ধে জিততে হলে মাঠে আসতে হবে। ভারতে বসে যুদ্ধ হবে না। নিজের হাঁটুর জোর না থাকলে অন্যের জোরে কাজ হবে না।
কেকে/ এমএস